
২০২৩ সালে পদার্থ বিদ্যায় তিন বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পান।
এরা হলেন যথাক্রমে পিয়ের অগস্তিনি ( Pierre Augostini ), নঅ্যান লুলিয়ের ( Anne L' Luiller ) এবং ফেরেন্জ ক্রাউস (Ference Krouz)।
প্রথম দুজন ফরাসী এবং শেষ জন অস্ট্রো হাঙারিয়ান ৷ অবশ্য অগস্তিনি কাজ করেছেন আমেরিকার ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এবং লুলিয়ের গবেষণা করেছিলেন সুইডেনের লান্ড (Lund) ইউনিভার্সিটিতে এবং ক্রাউসের গবেষণাগার জার্মানীর ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অফ কোয়ান্টাম অপটিক্স ৷
এঁরা যে বিষয়ে কাজ করেছিলেন তাহল অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্স ( Attosecond physics)।
অ্যাটোসেকেন্ড এত ক্ষুদ্র সময় যে আমরা কিছুতেই কল্পনা করতে পারবো না ৷ এক সেকেন্ড কে যদি একশো কোটি ভাগ করি এবং প্রতিটি ভাগকে আবার একশো কোটি ভাগ করি তবে তা হবে অ্যাটোসেকেন্ড ৷
এত ক্ষুদ্র সময় দরকার হয়েছিল অ্যাটমের মধ্যে ইলেকট্রনের গতিবিধি লক্ষ করার জন্য ৷ একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে ৷ আমরা যদি ঘরের সিলিং ফ্যান খুব জোরে চালাই তবে পাখার ব্লেড গুলো দেখতে পাবোনা। এমন কি পাখার ঠিক উপরের সিলিংএর অংশ পাখার ঠিক নীচে দাঁড়িয়ে দেখতে পাব ৷ কিন্তু হাই শাটার স্পীডের কোন ক্যামেরা দিয়ে ঘুরন্ত পাখার ছবি তুললে পাখাটি স্থির দেখাবে ৷ যে কেউ মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুললে পাখার ব্লেড গুলি দেখতে পাবে। এখন ICCD ক্যামেরা উদ্ভাবন হয়েছে যার শাটার স্পীড প্রায় ন্যানো সেকেন্ডের মতন ৷ কিন্তু এত উন্নত প্রযুক্তির ক্যামেরা ব্যবহার করেও পরমাণু র ভিতর ইলেকট্রনের চলা ফেরা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয় ৷
তাছাড়া এরকম কোন ক্যামেরা দিয়ে ইলেকট্রনকে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয় কারণ ইলেকট্রনের মত অতিক্ষুদ্র বস্তুর ক্ষেত্রে যে তত্ব প্রয়োগ করা হয় তা হোল কোয়ান্টাম মেকানিক্স ৷ কোয়ান্টাম মেকানিক্স তত্বের আবিষ্কারক ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক (Max Planck-) । প্ল্যাঙ্ক ব্ল্যাক বডি রেডিয়েশনের উপর কাজ করছিলেন ৷ আদর্শ ব্ল্যাক বডি তৈরী করা সম্ভব নয়। তবে যদি একটি গোলকের ভিতরে ভূষো বা অন্য কিছু দিয়ে ভিতরটা সম্পূর্ণ কালো রং করা হয় এবং গোলকটিতে একটি ক্ষুদ্র ছিদ্র করা হয় তাহলে ছিদ্র দিয়ে যে আলো প্রবেশ করবে তা এই গোলকটি সব শোষণ করবে ৷ এরপর ওই ব্ল্যাক বডি থেকে যে বিকীরণ বার হবে তা পরীক্ষাগারে মাপা যায় ৷ এর পর আমরা তাপ মাত্রার সঙ্গে বিকিরণের তরঙ্গ দৈর্ঘের যে সম্পর্ক তার চিত্ররেখা ( graph) আঁকতে পারি ৷ প্ল্যাঙ্ক দেখলেন প্রচলিত কোন তত্ত্বই এই চিত্র রেখা ব্যাখ্যা করতে পারছেনা অনেক তাত্বিক গবেষণা করে প্ল্যাঙ্ক দেখলেন আলো কে যদি কণার সমস্টি হিসেবে ধরা যায় তবে এই চিত্র রেখাটি সম্পূর্ণ ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় ৷ তিনি যে ফর্মূলা আবিষ্কার করেছিলেন তাকে প্ল্যাঙ্ক ডিস্ট্রিবিউশন বলা হয় ৷ আলো তা হলে ফোটন কণার সমষ্টি ৷ দুশ বছরেরও বেশী আগে নিউটন ও আলোর করপাসকুলার ( Corpuscular ) ধর্মের কথা উল্লেখ করেছিলেন ৷ তখন তাঁর এই তত্ত্ব তৎকালীন বিজ্ঞানীরা গ্রহণ করেন নি ৷
এরও প্রায় দুহাজার বছর আগে জৈন দার্শনিকরা এই তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন ৷ কিন্তু তখন, এমনকি নিউটনের আমলেও প্রযুক্তি এমন উন্নত ছিলনা যে ল্যাবরেটরিতে এটা প্রমাণ করা যেতে পারে ৷
ইয়ুঙ্ ( Thomas young - ১৭৭৩ — ১৮২৯ ) পরীক্ষা করে আলোর তরঙ্গ ধর্ম সুদৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ৷
প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্বের প্রধান প্রবক্তাদের মধ্যে ছিলেন আইনস্টাইন (Albert Einstein -১৮৭৯—১৯৫৫) ও নীলস বোর (Niels Bohr —১৮৮৫—১৯৬২)।
বস্তুত আইনস্টাইন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন প্রধানত ফোটো ইলেকট্রিক উপর তাঁর কাজের উপর যা মূলত কোয়ান্টাম তত্বকে মান্যতা দেয় ৷ নীলস বোর বিখ্যাত বোর মডেলের জন্য ( Bohr model )।
এই মডেলে হাইড্রোজেন পরমাণু কে সৌর জগতের মত ধরে নেওয়া হয় ৷ পরমাণুর কেন্দ্রে একটি ভারী কণা আছে ( রাদার ফোর্ড ' - Ernest Rutherford -1871-1937 ) ৷ আর একটি ইলেকট্রন এই প্রোটনকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে ঘুরে চলেছে ৷ অবশ্যই এই ঘুরে চলা কোয়ান্টাম সূত্র মেনে চলে ৷ সৌরজগতে যে বল কাজ করে তা হল মাধ্যাকর্ষণ ৷ আর হাইড্রোজেন পরমাণুর ক্ষেত্রে এটি হল কুলম্ব ফোর্স ৷ Coulomb force)।
হাইড্রোজেন পরমাণুর স্প্রেকটাম যা ল্যাবরেটারিতে পরীক্ষা করে পাওয়া যায় তার সঙ্গে বোর মডেলের গাণিতিক ফরমূলার মিলে যায় ৷ অবশ্য আরো সূক্ষ পরীক্ষায় যে তথ্য পাওয়া যায় তা একমাত্র ডিরাকের ( Paul Dirac - ১৯০২—১৯৮৪).ফরমূলায় ব্যাখ্যা করা যায় ৷ আমরা এখাঁনে তার বিশদ বিবরণে যাবনা ৷ তবে বলা যায় ১৯৩০ দশকে কোয়ান্টায়াম তত্ত্বের প্রায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে ৷ বহু বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন ৷ যেমন ডিরাক ,শ্রয়ডিঙ্গার (!Schrodinger -১৮৮৭—১৯৬১), হাইসেনবার্গ ( Werner Heisenberg-- ১৯০১—১৯৭৬ ), ফার্মি ( Enrico Fermi - ১৯০১—১৯৫৪), পাউলি ( Wolfgang Pauli - ১৯০০—১৯৫৮ ) এবং আরো অনেক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী যাঁরা প্রায় সবাই পদার্থ বিদ্যায় নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন ৷
এরামধ্যে বলা যায় সবচেয়ে বৈপ্লবিক তত্ত্বের আবিষ্কারক হলেন হাইসেনবার্গ ৷ এটি অনিশ্চয়তা বাদ ( Uncertainty principle )। .এই তত্ত্ব অনুযায়ী, কোন কণারই ভরগতিবেগ (momentum) ও তার অবস্থান একই সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা যাবেনা ৷ এটা যন্রের সীমিত ক্ষমতার জন্য নয়। এটা প্রকৃতির নিয়ম। অর্থাৎ বোরের মডেলে যে চিত্র ছিল তা অতি সরলী করণ ৷
এখন যদি আদৌও পরমানুর ভিতর ইলেকট্রনের গতিবিধির রেখাচিত্র কল্পনা করা যায় তবে তা হবে ইলেকট্রন ক্লাউড ৷ অর্থাৎ আমরা শুধু জানতে পারবো কোন স্থানে ইলেকট্রনের উপস্থিতির সম্ভাবনা ৷ কোয়ান্টায়ামের জগৎ হল সম্ভাবনার জগৎ ৷ তাহলে ২০২৩ সালে যাঁরা নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন তাঁরা ইলেকট্রনের গতিবিধি ধরতে পেরেছিলেন কি ভাবে? তাঁদের আবিষ্কার কি হাইসেনবার্গের তত্ত্ব কে ভুল প্রমানিত করে? আর তাঁরা পরমানুর ভিতরে ইলেকট্রনের অবস্থিতি ধরলেন কি করে ? এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী আলো ফোটন কণার সমষ্টি হলেও আলোর তরঙ্গ ধর্ম ও পরীক্ষিত ৷ বস্তুত লুই দে ব্রলীর ( Lois XDe Broili ) র তত্ত্ব অনুযায়ী শুধু আলো নয় সমস্ত কণার এই দ্বৈত চরিত্র বা ডুয়াল চরিত্র আছে ৷ ইলেকট্রন , প্রোটন , নিউট্রন প্রভৃতি সব কণার ই এই দ্বৈত চরিত্র আছে ৷ খুব বড় বস্তুর ক্ষেত্রে এই তরঙ্গের দৈর্ঘ খুব বেশী বলে তা ল্যাবরেটরিতে পর্ষবেক্ষণ করা সম্ভব নয় ৷
এখন আমরা আলোচনা করব ২০২৩ সালে যাঁরা পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়ে ছিলেন তাঁদের গবেষণার মূল বিষয় নিয়ে ৷ এঁরা পরমাণুর ভিতর ইলেকট্রনের গতিবিধি লক্ষ করার জন্য অতি অল্প সময় স্থায়ী আলোর ঝলক বা pulse তৈরী করেছিলেন যার সময়ের মাপ করা হয় অ্যাটোসেকেন্ডের এককে ( প্রায় একশো) ৷ এটি সম্ভব হয়েছিল বিভিন্ন তরঙ্গের আলোর ( লেজার রশ্মি ) মিশ্রণে এক জটিল এবং অত্যন্ত উন্নত মানের প্রযুক্তির মাধ্যমে ৷
এই লেজার রশ্মি দিয়ে নোবল গ্যাসের ( যেমন নিয়ন " ক্রিপটন ইত্যাদি ) পরমাণুর সাথে আলোর সংঘাত ঘটিয়ে কি ভাবে আমরা ইলেকট্রনের গতিবিধি জানতে পারব ?
না ,সরাসরি আমরা ইলেকট্রনকে দেখতে পারব না ৷ তবে ওই সব গ্যাসের অভ্যন্তরে যে ইলেকট্রন আছে তাদের সঙ্গে লেজার রশ্মির সংঘাতে কিছু ইলেকট্রন বেরিয়ে আসতে পারে আবার কিছু ইলেকট্রন আলোর থেকে শক্তি অর্জন করবে এবং অচিরে তার থেকে আলোর বিকিরণ হবে ৷ তবে শোষিত আলোর কম্পাঙ্ক থেকে এই বিকিরণের কম্পাঙ্ক কম হবে ৷
এই বিকিরণ কে ধরতে গেলে অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী আলোর পালস দরকার ৷ এই সময়ের ইউনিট হল অ্যাটোসেকেন্ড ৷ ( এই এককের মাপে একশো তিরিশ একক স্থায়ী পালস তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিলেন অগস্তনি) ৷
কিন্তু ইলেকট্রন ও তার গতি বিধি পর্যবেক্ষণ করতে পারলে কি তা হাইসেনবার্গের অনিশ্চয়তাবাদ থিয়োরী যে ভুল তা প্রমাণিত হবে ? এখনি তা বলা যাচ্ছেনা ৷ কারণ স্বয়ং লুলিয়ের বলেছেন যে ইলেকট্রন কে তাঁরা ধরতে পেরেছেন তার ছবি কিন্তু শার্প নয় ৷ ওনার ভাষায় ঝাপসা (blurry)। একটা প্রশ্ন সাধারণ মানুষ করতেই পারেন ৷ এই আবিষ্কার পদার্থ বিজ্ঞানের বিশেষ আবিষ্কার সন্দেহ নেই , কিন্তু সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তা কি কাজে লাগবে ৷ প্রথমেই বলে রাখি বিজ্ঞানের কোন আবিষ্কারের পর বেশ কিছুদিন লাগে আমাদের জীবনে তার ব্যবহারিক প্রয়োগে ৷ উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় রান্টগিয়েন ( Wihelm Rontgen-১৮৪৫—১৯২৩) যখন এক্স রে আবিষ্কার করেছিলেন তখন কি ভেবেছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর এত ব্যাপক প্রয়োগ হবে যে প্রত্যন্ত গ্রামের লোকেরা ও এক্সরে শব্দটার সঙ্গে পরিচিত হবে ৷ আবার এখন আমরা দৈনন্দিন জীবনে যে সমস্ত গ্যাজেট ব্যবহার করি তার অধিকাংশ যেমন সেলফোন , কমপিউটার , টিভি ইত্যাদি তার পিছনে আছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও আলো যে বিদ্যুতচৌম্বকীয় তরঙ্গ এই তথ্যের আবিষ্কার ৷ ২০২৩ সালে যাঁরা পদার্থ বিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তাঁদের এবং আরো অনেক বিজ্ঞানীদের দের মতে ক্যানসার ইত্যাদি জটিল রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এই আবিষ্কার কাজে লাগবে ৷ এর প্রয়োগ হয়ত হবে সুদুর প্রসারী ৷
এখানে আর একটা কথা বলা দরকার ৷ বিজ্ঞানে কোন থিয়োরীই ধ্রুব সত্য নয় ৷ যতক্ষণ সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা কোন বিশেষ থিয়োরীর সমস্ত গণনা র সঙ্গে মিলে যাচ্ছে ততক্ষণ সেই থিয়োরী তে আমরা বিশ্বাস করি ৷ অবশ্য একটি মাত্র পরীক্ষা বা নিরীক্ষাই কোন থিয়োরী কে ভুল প্রমাণিত করতে পারে ৷ নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ থিয়োরী আড়াইশো বছরের ও বেশী সময় ধরে প্রায় ঈশ্বর প্রদত্ত তত্ত্ব বলে গণ্য হত ৷ কিন্তু বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কোয়ান্টাম তত্ব ও আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ প্রমাণ করল নিউটনের তত্ত্ব সব জায়গায় খাটেনা ৷ অতি ক্ষুদ্রবস্তুর ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম তত্ব ও মহাবিশ্ব গবেষণায় আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা বাদ এখনো পর্যন্ত ভুল প্রমাণিত হয়নি ৷ অতি দ্রুত গতিতে চলা বস্তুর ক্ষেত্রেও নিউটনের তত্ব খাটবেনা ৷ তবে এখনো পর্যন্ত সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ ও কোয়ান্টাম তত্ব কে একসূত্রে বাঁধা যায়নি ৷ তবে বিজ্ঞানে কোন জিনিসই থেমে থাকেনা ৷
ভবিষ্যতে অ্যাটোসেকেন্ডের থেকেও কম সময়ের পালস তৈরী করা সম্ভব হলে সৃষ্টি রহস্যের উন্মোচনের দিকে আরো একধাপ এগোনো যাবে ৷