সূচিতে ফিরুন

বিটোভেনের চুল

লেখক - দীপঙ্কর বসু
img

এপ্রিল মাসের ১২ তারিখ। গরম ভালই পড়েছে। হাওয়াও নেই। তার সঙ্গে আকাশ খানিকটা মেঘলা হওয়ায় গরমটা বেশ অসহ্য। আড্ডার নেশা বড় নেশা। তাই এই অস্বস্তিকর গরমের মধ্যেই প্রতি রবিবারের মতই আমাদের আসর বসেছে পরান দার চায়ের দোকান কাম রেস্টুরেন্টে। তবে গত একমাস ধরেই আমাদের এই আসরে কোন প্রাণ নেই। থাকবেই বা কি করে! আসরের মধ্যমণি নকা মামারই যে দেখা নেই। সেই যে একমাস আগে উধাও হয়েছেন, তার পরে ওঁর আর কোন খোঁজ নেই। বাড়ির লোকেরাও জানেন না কি কাজে উনি কোথায় গেছেন। শুধু বেরোনোর সময় বলে গেছেন যে বিশেষ একটা কাজে উনি বাইরে যাচ্ছেন। বাইরেটা দেশের মধ্যে না বিদেশে,না কি পৃথিবীর বাইরে তা কেউ জানে না। আমাদের এবং ওঁর বাড়ির লোকদের অবশ্য এই অভিজ্ঞতা আগেও বহুবার হয়েছে। তবে নকা মামা না থাকলে যা হয় আমাদের রবিবারের আসরের মজাটাই উধাও। সেদিনের আসরেও গোবিন্দ বাবু, অমল ত্রিপাঠি, অপূর্ব বাবু, দেবাশিস বাবু, সমীরণ বাবু, আমাদের একমাত্র মহিলা সদস্য থিটা সবাই হাজির। আলোচনা চলছিল পাশ্চাত্য সঙ্গীত নিয়ে। আলোচনার শুরু করেছিলেন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের দুই ভক্ত ইতিহাসের শিক্ষক দেবাশীস বাবু এবং কর্পোরেট ম্যানেজার থিটা। দুজনের মধ্যে তর্ক বেঁধে গেল বিটোভেন এবং মোজার্টের মধ্যে কে বেশি ভালো তাই নিয়ে। বিজ্ঞানের শিক্ষক অপূর্ব বাবু আবার আইনস্টাইনের ভক্ত। আইনস্টাইন বিটোভেন এবং মোজার্টকে নিয়ে কি বলেছেন তা নিয়ে একপ্রস্থ বক্তব্য রাখলেন তিনি। ভাবলাম,তর্কটা থামবে কিংবা অন্য দিকে ঘুরে যাবে। কিন্তু তেমনটা হল না। বিটোভেন এবং মোজার্টকে নিয়ে ঝগড়া চলতেই থাকল।

এমনই আবহাওয়ায় হঠাৎ ধূমকেতুর মত উদয় হলেন নকা মামা। এসেই বললেন, “ আপনারা যাঁদের নিয়ে ঝগড়া করছেন, জানেন সেই মোজার্ট বিটোভেন সম্বন্ধে কি বলেছিলেন?” সবাই মায় দেবাশীস বাবু এবং থিটা পর্যন্ত মুখে কুলুপ এঁটে এ ওর মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগলাম। কথিত আছে বিটোভেনের তরুণ অবস্থায় একটি অনুষ্ঠানে তাঁর বাজনা শোনার পর মোজার্ট বলেছিলেন,” এই ছেলেটিকে দেখে রাখ, একদিন এই ছেলেটি পৃথিবীকে এমন সুর উপহার দেবে যা লোকের মুখে মুখে চর্চার বিষয় হবে।“

কথাটি বলে সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়ে মামা বসে পরাণদাকে চা দিতে বললেন। একটু পরে মামা চায়ে চুমুক দিয়ে একটু থিতু হওয়ার পরে জিজ্ঞাসা করলাম,”এতদিন কোথায় ছিলেন মামা? “ মামা মুচকি হেসে বললেন,” এতক্ষণ যাঁদের নিয়ে তর্ক হচ্ছিল তাঁদের মধ্যে একজন, বিটোভেনের ব্যাপারে এক বন্ধু বিজ্ঞানীর আহ্বানে যেতে হয়েছিল তাঁর রসায়নাগারে।

“ গোবিন্দ বাবু যিনি ঢোল গোবিন্দ নামে সাহিত্য জগতে পরিচিত তিনি ফুট কেটে বললেন,“ শেষে মশাই আপনি বিটোভেনকেও ছাড়লেন না”।

মামা গুম মেরে গেলেন। আমরা একটা দারুণ গল্পের সলিল সমাধি রুখতে গোবিন্দ বাবুকে থামতে বললাম। সমীরণ বাবু মামাকে শান্ত করতে গোবিন্দ বাবুকে বললেন, “ আপনার যত দৌড় তো মশাই ভারতের মধ্যেই। আপনি কি করে বুঝবেন মামার কাজের পরিধি!” এরপর মামাকে শান্ত করতে আমি পরাণদাকে ওঁর জন্য এক কাপ স্পেশাল চা আর দুটো ফিসফ্রাইয়ের অর্ডার দিয়ে দিলাম। মামা শান্ত হয়ে শুরু করলেন ওঁর গল্প।

“ বেশ কয়েক মাস আগের কথা। এ সি চালিয়ে শুয়ে একটা গল্পের পড়ছি। একটা ফোন এল বিটোভেনের ভক্ত এক বিজ্ঞানী বন্ধুর কাছ থেকে। ওঁ নিজের বানানো টাইম মেশিনে গিয়ে বিটোভেনের সঙ্গে দেখা করতে চায়। আমাকেও ওঁর সঙ্গে যেতে অনুরোধ করলো। না বলতে পারলাম না।

নির্দিষ্ট দিনে টাইম মেশিনে করে আমরা বিটোভেনের বেঁচে থাকার সময়কালে পৌঁছে গেলাম ভিয়েনায়। যদিও তিনি জন্মেছিলেন বনে, কিন্তু জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি কাটিয়েছিলেন ভিয়েনায়। শহরতলিতে থাকা ওঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা করলাম ওঁর সঙ্গে। তখন উনি বেশ অসুস্থ। সম্পূর্ণ বধির। আমরা দুশ বছর পরের সময়কাল থেকে এসেছি শুনে ওঁর ভাই প্রায় পঁচিশ বছর আগে ওঁর লেখা একটি উইল দেখালেন। এই উইলে বিটোভেন ওঁর ভাইকে মিনতি করেছেন ওঁর সামগ্রিক স্বাস্থ্যের অবস্থার কথা জন সমক্ষে আনার জন্য। কেননা সে সময়ে ওঁর অসুস্থতা নিয়ে নানা রকম গুজব চালু ছিল। যখন উনি শুনলেন যে একবিংশ শতাব্দীতেও এই রহস্যের সমাধান হয় নি। তখন ওঁর ভাই আমাদের অনুরোধ করলেন আমরা যেন বিটোভেনের অসুস্থতার কারণের বিশদ অনুসন্ধান করে এই রহস্যের আবরণ উন্মোচন করে মানুষকে জানাই।

তারপর আমরা টাইম মেশিনে ফিরে এলাম আমাদের বর্তমান সময়ে। বন্ধুবর এই বিষয়ের গবেষণায় একজন নামী বিজ্ঞানী হওয়ায় আমি ওঁকে অনুরোধ করলাম, ওঁ যেন এ বিষয়ে বিশদে গবেষণা করে এমন একজন বিশ্ব বিখ্যাত সুরকারের ইচ্ছার মর্যাদা দেয়। কয়েক মাস আগে শেষ হয়েছে সেই গবেষণা। বিটোভেনের মৃত্যু নিয়ে আগে বিজ্ঞানী এবং মানুষরা যা জানতেন এই গবেষণা তাকে নাকচ করে দিয়েছে।”

এর মধ্যে ফিস ফ্রাই এসে গিয়েছিল। সেটিকে আস্তে ভেঙে রসনাকে তৃপ্ত করার জন্য থামলেন নকামামা। জোরদার রহস্যের গন্ধ পেয়ে আমরাও নড়েচড়ে বসলাম। উত্তেজিত থিটা বলল,” মামা, আগের পরের সব কিছুই কিন্তু বলতে হবে। কোন কিছুই ছাড়া চলবে না।“ শান্ত ভাবে মামা ফ্রাইটা শেষ করে, হাত টাত মুছে আবার শুরু করলেন ওঁর কাহিনী।

“১৮২৭ সালের মার্চ মাসের এক ঝোড়ো সোমবার দীর্ঘ রোগভোগের পর মারা গেলেন বিটোভেন। মৃত্যুর সময় ওঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৬ বছর। আগের ক্রিসমাস থেকেই উনি শয্যাশায়ী ছিলেন। উদর ও অন্যান্য অঙ্গ ফুলে গিয়েছিল। শ্বাস প্রশ্বাসেও কষ্ট হচ্ছিল। আপনারা সবাই জানেন, ৪৪ বছর বয়সে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সুরকার সম্পূর্ণ বধির হয়ে গিয়েছিলেন। মাত্র ২৮ বছর বয়সেই বিটোভেনের শ্রবণের সমস্যা শুরু হয়েছিল । এর সঙ্গে দীর্ঘ স্থায়ী পেট ব্যথা , ডায়রিয়া এবং অন্যান্য রোগ ছিল ওঁর নিত্যদিনের সঙ্গী। মৃত্যুর ছ বছর আগে বিটোভেনের যকৃতের রোগ ধরা পড়ে। বধির হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা এই সুরকারকে এতটাই আশাহত করেছিল যে তিনি ভাইয়ের কাছে তাঁর আত্মহত্যার চিন্তার কথা স্বীকার করেছিলেন।“

কথাটা আমাদের হতবাক করে দিয়েছিল। বিটোভেনের ভক্ত থিটা তো কেঁদে ফেললো।

মামা থিটার মাথায় হাত দিয়ে ওকে শান্ত করে বললেন,”এখনই এত অবাক হও না রহস্যের এখনো অনেক বাকি। ২০০৭ সালে বিখ্যাত এই সুরকারের চুল নিয়ে এক ফরেনসিক তদন্ত হয়। এই তদন্তে বিটোভেনের মৃত্যুর জন্য সীসার বিষক্রিয়াকে দায়ী করা হয়। সে সময়ে সীসার পাত্রে পানীয় পান করার প্রচলন থাকায় এবং চিকিৎসায় বিভিন্ন ওষুধে সীসার ব্যবহার থাকায় তদন্তের এই উপসংহারে বিজ্ঞানীরা তেমন অবাক হন নি।

আমরা টাইম মেশিনে বর্তমান সময়ে ফিরে আসার পর, এই রহস্য সমাধানে নতুন করে গবেষণা শুরু করেন আমার বন্ধুবর। তিনি এর আগে বিশ্লেষন করা বিটোভেনের লতানো চুলের নমুনার জিনের বিশ্লেষন করে এক অদ্ভুত জিনিষ আবিষ্কার করেন। তিনি দেখেন, যে চুলের নমুনা বিশ্লেষন করে সীসার বিষক্রিয়ার কথা বলা হয়েছিল তা মোটেই বিটোভেনের চুল নয়। তা একজন মহিলার চুল।“

আমরা তো ঘটনার এমন মোড়ে একেবারে হতবাক। সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি হেসে আবার শুরু করলেন নকা মামা। “এর পর বন্ধুবর ১৮২৭ সালে বিটোভেনের একটি চিঠির সঙ্গে থাকা চুল এবং অন্যান্য বিশ্বাস যোগ্য চুলের নমুনা নিয়ে তার জিনের বিশ্লেষন করেন।

এই বিশ্লেষন করে বন্ধুবর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে বিটোভেনের মৃত্যু হয়েছিল হেপাটাইটিস বি এর সংক্রমনে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর অত্যধিক সুরাপানের অভ্যাস।ওঁর জিনে যকৃত রোগের ঝঁকির কারণও আবিষ্কার করেন বন্ধুবর । তবে এখনও পর্যন্ত বিটোভেনের বধির হয়ে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় নি। পুরো গবেষণাটা প্রকাশ করার আগে আমাকে একবার দেখিয়ে নেওয়ার জন্য আমাকে ডেকেছিলেন বন্ধুবর। তাই কিছুদিন ওঁর সঙ্গে ওঁর রসায়নাগারে থাকতে হয়েছিল আমাকে“ বলে থামলেন নকা মামা। থিটার মুখে দুঃখের চিহ্ন ফুটে উঠল। এমন এক প্রতিভাধর মানুষের এমন পরিণতি আমাদেরও মনটা খারাপ করে দিল।

নকামামা চটি পায়ে গলিয়ে বেরোবার উপক্রম করতেই সমীরণ বাবু বললেন,” তা নকা মামা এটা কি হল, কল্পবিজ্ঞান না গল্প বিজ্ঞান?

নকা মামা হেসে বললেন, তা আপনারাই ঠিক করুন। আপনাদের এটা হোম টাস্ক রইল। বলে নকা মামা হন হন করে বেরিয়ে গেলেন। আমরাও আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।