
শনিবার বলে প্রত্যয় আজ দুটোর সময় স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এসেছে। এপ্রিল মাসের চড়া রোদ। সাইকেলে চেপে স্কুলে যায় বলে ছাতা নিয়ে যায় না। একহাতে সাইকেলের হাতল ধরে অন্য হাতে ছাতা ধরে চালাতে সমস্যা হয়, বিপদের ঝুঁকি থাকে। তার ওপর রাস্তায় দিয়ে যখন যায় তখন রাস্তার থেকে আশেপাশের গাছ-গাছালির দিকে নজর থাকে বেশি। কোন গাছে কী ফুল ফুটেছে, কোন পাখি বসে আছে, কোন পাখি ডাকছে - এসবে প্রত্যয়ের আগ্রহ আশৈশব। মা বাবা বারবার বলে দেয়, ওরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে সাইকেল চালাবি। কিন্তু রাস্তায় বেরোলেই সে সব কথা আর মাথায় থাকে না। এজন্য মাঝে মাঝে মা সাইকেল দিতে চায় না। বলে, হেঁটেই যাবি আসবি। তবুও সাইকেলেই স্কুলে যাওয়া আসা করে। হাঁটতে ওর বড়ই কষ্ট।
আজ রোদে বেশ কষ্ট হয়েছে। বাড়ি ফিরে ঠান্ডা দইয়ের শরবত খেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে বিছানার উপর বালিশে হেলান দিয়ে বসেছে। ঠিক সেই সময় জানালার বাইরে আম গাছ থেকে বেশ জোরালো আওয়াজ শোনা গেল - 'টেট টো টিউল'। এই ডাক প্রত্যয়ের খুব চেনা। কালো মাথা বেনে বউ পাখি দুটো বাসা করেছে ওই আম গাছে। জানালা দিয়ে ওদের বাসা তৈরি করা দেখেছে। কী সুন্দর ছোট্ট দোলনার মতো বাসা। দুটো শাখার সংযোগ থেকে দোল খাচ্ছে। বাসাতে সকাল বিকেল ওদের ডিমে তা দিতেও দেখে। কিন্তু কে তা দেয় তা বুঝতে পারে না। কারণ ওদের পুরুষ আর স্ত্রী পাখি দুটো মনে হয় একই রকম দেখতে। ডাক শুনে জানালার পাশে মাথা নিয়ে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই নজরে পড়ল জানালার উপরের দিকের একটা ডালে একটা বেনে বউ বসে রয়েছে।
- কী ভাবছো খোকাবাবু?
বেশ মিষ্টি সুরে বেনে বউটা প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল।
প্রত্যয় তো অবাক! এ কী কাণ্ড! বেনে বউটা মানুষের মতো করে তার সাথে কথা বলছে! সে যা হোক, বেনে বউ যখন কথা বলেইছে প্রত্যয় কি আর চুপ করে থাকতে পারে?
- এইতো, তোমাকেই খুঁজছিলাম গো।
- কেন? কিছু দোষ করলাম নাকি?
- না না, দোষ করবে কেন? আমি তোমাদের খুব ভালোবাসি। আসলে আমি ভাবছিলাম, ওই যে তোমাদের বাসায় যে তা দিচ্ছে ও বর নাকি বউ?
কথা শুনে বেনে বউটা মানুষের মতো হো হো করে হেসে উঠল। তবে সে হাসিও ভারি মিষ্টি।
- হেসে উঠলে যে? আমি কি কিছু ভুল বললাম?
- আরে না না। ভুল বলবে কেন? তোমার প্রশ্ন শুনে মজা পেলাম, তাই।
- মজা ছেড়ে আমার প্রশ্নের উত্তরটা দাও না। কথাটা কিন্তু আমি বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছি।
- যদি আমি বলি যে আমি বউ আর ও হল বর, তুমি বিশ্বাস করবে?
- আমি তোমাদের কথা বিশ্বাস করবো। কারণ আমি তোমাদের ভালোবাসি। আর তোমরাও আমাদের ভালোবাসো। মানুষ তোমাদের ক্ষতি করে ঠিকই কিন্তু তোমরা কখনও আমাদের ক্ষতি করো না। তাই তোমরা মিথ্যে বলতেই পারো না।
- বাহ, কী সুন্দর করে বললে তো কথাগুলো! আমি কিন্তু তোমার মুখে অনেক কথা জানালা দিয়ে শুনতে পাই। সেসব শুনে বুঝি, তুমি খুব ভালো ছেলে। কিন্তু তুমি তো খুদে বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানীরা তো পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে কিছু সিদ্ধান্তে আসে না। তাই না? তাহলে আমার মুখের কথায় কেন বিশ্বাস করবে?
- তা ঠিক বলেছো। কিন্তু কী করে পরীক্ষা করব বলো তো? হ্যাঁ যদি ডিসেকশন করা হয় তাহলে স্ত্রী পুরুষ বুঝতে পারবো। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। তাছাড়া প্রকৃতি থেকে জীবিত পাখি ধরা বেআইনি, আর তাকে হত্যা করা তো মারাত্মক অপরাধ। তাহলে পরীক্ষা করার উপায়ই বা কী?
- সত্যি, এ ব্যাপারে তোমরা কিন্তু অসহায়।
- আমি কিন্তু টিয়া পাখি, মৌটুসী পাখি, দুর্গা টুনটুনি পাখি, দোয়েল পাখি, কোকিল, ময়ূর দেখে স্ত্রী পুরুষ চিনতে পারি। কিন্তু তোমাদের বা শালিক, ছাতারে, কাক এদের চিনতে পারি না। এমন কেন হয় বলো তো? মানুষ, গোরু, কুকুর, বিড়াল - এদের তো আমরা স্ত্রী পুরুষ দেখেই চিনতে পারি।
- আমরাও কিন্তু আমাদের মধ্যে কে স্ত্রী আর কে পুরুষ দেখে চিনতে পারি।
- এই, তুমি কিন্তু ঢপ দিচ্ছ। আমাদের ক্লাসে অনীক আর অভীক পড়ে। যমজ ভাই। ওদের দেখে একেবারেই চেনা যায় না কে অভীক আর কে অনীক।
- আমাদের ব্যাপারটা কিন্তু তেমন নয়। আমরা চিনতে পারি।
- আরে কীভাবে চেনো সেটা তো বলবে।
- বেশ বলবো, তার আগে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আমি কিন্তু পরীক্ষা করব তুমি কেমন পড়াশোনা করেছ।
- বাপরে বাপ! তুমি আবার কবে থেকে মাস্টারি শুরু করলে?
- ধরে নাও আজ থেকে। এখনই তাহলে প্রশ্নগুলো শুরু করি?
- ঠিক আছে, যদি উত্তর জানা থাকে নিশ্চয়ই বলবো।
বেনেবউটা এবার গাছের শাখা থেকে লাফ দিয়ে জানালার রডের ওপর বসল। তারপর জিজ্ঞাসা করলো - আচ্ছা বলতো, তোমরা বিভিন্ন জিনিসের বিভিন্ন রঙ, মানে কোনটা লাল, কোনটা সবুজ, কোনটা হলুদ, কোনটা নীল, কোনটা বেগুনি - এইসব রঙ কীভাবে বুঝতে পারো?
প্রত্যয় প্রশ্ন শুনে হো হো করে একচোট হেসে নিল। বলল, তোমার প্রশ্ন কিন্তু খুব সোজা। এগুলো তো ক্লাস টেনেই কয়েকদিন আগে পড়েছি।
- ঠিক আছে। তাহলে সোজা উত্তরটাই বলো।
- সূর্য থেকে যে আলো পৃথিবীর দিকে আসে তার মধ্যে দৃশ্যমান আলোক বর্ণালী আমাদের রঙ বুঝতে সাহায্য করে। দৃশ্যমান আলোক বর্ণালীতে রয়েছে সাতটি রঙ যেগুলোকে আমরা বলি বেনীআসহকলা, ইংরেজিতে VIBGYOR, মানে বেগুনি নীল আ....
প্রত্যয়ের কথা থামিয়ে বেনেবউ বলে উঠল, এগুলো তো সবাই জানে। আমি এটা জানতে চাইনি। আমি জানতে চাইছি কীভাবে তোমরা বিভিন্ন রঙ দেখো।
- এই তো কথার মাঝে ডিস্টার্ব করো। আমি তো বলছি। শোনো, এই যে সাতটা রঙের আলোকরশ্মি, সেগুলো নানা বস্তুর ওপরে এসে পড়ে আর তারপর প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে পৌঁছায়। তখনই আমরা সেই বস্তুকে দেখতে পাই। কোনও বস্তু যদি এই সাতটা রঙের বর্ণালীর মধ্যে কোনও একটি বা দুটি বর্ণালীর আলো প্রতিফলিত না করে তাহলে আমরা সেই রঙ বা প্রতিফলিত না হওয়া রঙগুলো মিশে তৈরি হওয়া অন্য কোনও রঙের শেড দেখতে পাই। আর যদি কোনও আলো প্রতিফলিত না করে তাহলে সেই বস্তুকে দেখি কালো। আর যদি সাতটা আলোক বর্ণালীকেই প্রতিফলিত করে দেয়। তবে সেই বস্তুকে আমরা দেখি সাদা। তুমি তো সবজান্তা! কী, ঠিক বললাম তো?
- হ্যাঁ তুমি যা বলেছো ঠিকই বলেছো। কিন্তু এটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়। আমি বলতে চাইছি তোমার চোখ কীভাবে রঙ দেখে?
- এই কথা! তাহলে তো প্রশ্নটা ঠিকঠাক করতে হয়। যাক গে, তোমার প্রশ্নে কিন্তু একটু ভুল আছে। চোখ কিন্তু আদৌ রঙ দেখে না। আসলে চোখ কোনও জিনিসের ছবি তোলে আর চোখের রেটিনায় থাকা বিভিন্ন গ্রাহক কোশ রঙের সংকেত গ্রহণ করে। তারপর সেই সংকেত পৌঁছে যায় আমাদের মস্তিষ্কের দৃষ্টিকেন্দ্রে। সেখানে চোখ থেকে আসা সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণ হওয়ার পর আমরা শুধু রঙ নয় বস্তুটির আকার, আয়তন, দূরত্ব সবকিছু বুঝতে পারি।
- বাঃ, কী সুন্দর করে বুঝিয়ে বললে তো! তুমি মনে হয় বড়ো হয়ে শিক্ষক , না হয় অধ্যাপক হবে। প্রশংসা ঝরে পড়ল বেনে বউয়ের গলায়।
- একদম আমার মনের কথা বলেছো। প্রশংসা শুনে প্রত্যয়ের চোখ-মুখও খুশিতে ঝলমল করে উঠল।
- হ্যাঁ, যা বলছিলে তার পর থেকে বলো।
প্রত্যয় আবার শুরু করল – আমাদের চোখের রেটিনায় রড কোশ আর কোন কোশ নামে দু’প্রকার দৃষ্টি গ্রাহক কোশ আছে। রড কোশ কেবল খুব হালকা আলোয় দেখতে সাহায্য করে। রঙ চিনতে সাহায্য করে না। কিন্তু কোন কোশ উজ্জ্বল আলোতে দেখতে আর রঙ বুঝতে সাহায্য করে। একটানা বলে প্রত্যয় এবার লম্বা করে প্রশ্বাস নিল।
- আরে ভাই এগুলো তো আমিও জানি। নানা রঙ কীভাবে চেনো তা তো বলো!
- এর বেশি আমি তো পড়িনি। তুমি জানো? পাল্টা প্রশ্ন প্রত্যয়ের।
এবার বেনে বউয়ের ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি – জানি তো। শুনবে?
- শুনবো, শুনবো। হামলে পড়ল প্রত্যয়।
বেনে বউ শুরু করল - ওই যে তুমি একটু আগে কোন কোশের কথা বলছিলে না, সেটা তোমাদের চোখের রেটিনাতে তিন ধরনের আছে। একটি হল S-কোন। নীল আলোর অর্থাৎ ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের প্রতি এই কোন কোশ সংবেদনশীল। দ্বিতীয় প্রকার হল M-কোন। সবুজ আলোর প্রতি অর্থাৎ মাঝারি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের প্রতি এই কোশ সংবেদনশীল। আর শেষে L-কোন। লাল আলোর প্রতি অর্থাৎ বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের প্রতি এই কোশ সংবেদনশীল। প্রতি প্রকার কোন কোশ তোমাদের ব্রেইনে আলাদা আলাদা সংকেত পাঠায়। তারপর তোমাদের ব্রেইন আলাদা আলাদা সেই সংকেতগুলোকে বিশ্লেষণ করে তোমাকে বুঝিয়ে দেয় তুমি কোন রঙ দেখবে।
- বাহ দারুন ব্যাপার তো! এটা তো জানতাম না!
- হ্যাঁ, যদি সবগুলো কোন কোশ সমপরিমাণ সংকেত পাঠায় তাহলে তোমার ব্রেইন তোমাকে দেখাবে সাদা। যদি S-কোন থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সংকেত আসে তাহলে তুমি দেখবে নীল। আবার যদি M আর L-কোন S-কোন থেকে বেশি সংকেত পাঠায় তাহলে তুমি দেখবে হলুদ। এভাবেই তোমরা নানা রকমের রঙ দেখো।
- বাহ অনেক কথা জানলাম। তাহলে এবার বুঝতে পারলাম বর্ণান্ধ কেন হয়। যে ধরনের কোন কোশ কোনও মানুষের রেটিনায় থাকবে না সে সেই রঙ বুঝতে পারবে না। তাই তো?
- একদম তাই।
- আচ্ছা, আমাদের মতো এইরকম তিন প্রকার কোন কোশ আর কার কার আছে?
- শোনো, বানর হনুমান গরিলা শিম্পাঞ্জি ওরাং ওটাং এইসব প্রাণীদের দৃষ্টি তোমাদের মতোই। তবে প্যাঁচার দৃষ্টি কিন্তু তোমাদের মতো। নিশাচর প্রাণী কিনা।
- তার মানে আমরা যেভাবে রঙ দেখতে পাই তোমরা তেমনভাবে দেখো না?
- না। তোমাদের থেকে আরও ভালো, আরও নিখুঁতভাবে আমরা রঙ বুঝতে পারি।
- দারুন তো, একটু বুঝিয়ে বলো না প্লিজ। প্রত্যয়ের গলায় আকুতি ঝরে পড়ল।
- নিশ্চয়ই বলব। তোমাদের রেটিনাতে যে তিন প্রকার কোন কোশ আছে আমাদের চোখের রেটিনাতে সেই তিন প্রকার কোন কোশ ছাড়াও অতিরিক্ত আরেক প্রকার কোন কোশ আছে। আর সেই কোন কোশ অতিবেগুনি রশ্মির প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। এর নাম সায়ান কোন কোশ। অতিবেগুনি রশ্মিও তো রঙ সৃষ্টি করে, তাই না?
- তাহলে আমরা অতিবেগুনি রশ্মি থেকে তৈরি রঙ বুঝতেই পারি না?
- না, পারো না। কিন্তু আমরা পারি। এই কারণে যে রঙগুলো তোমাদের চোখে ধরা পড়ে না আমাদের চোখে সেই রঙ ধরা পড়ে। এই কারণেই তোমাদের চোখে স্ত্রী আর পুরুষ বেনে বউ একই রকম দেখালেও আমাদের চোখে কিন্তু আলাদা। ওই অতি বেগুনি রশ্মির প্রতিফলন থেকে আমরা বুঝে যাই কে পুরুষ আর কে স্ত্রী। রঙের পার্থক্য আছে। ওই পার্থক্য তোমাদের চোখে ধরা পড়ে না। তাই তোমরা একই রকম দেখো।
- এতো দারুণ বিস্ময়কর ব্যাপার।
- শুধু এটুকুই নয়। আরও আছে। তোমাদের থেকে আমাদের চোখে কোন কোশের পরিমাণও অনেক বেশি। ফলে রঙের সূক্ষ্মতার বিভিন্ন যে পার্থক্য তা আমাদের চোখে ধরা পড়লেও তোমাদের চোখে ধরা পড়ে না।
- উরিব্বাস আমরা তো দেখছি তোমাদের থেকে অনেক রঙ কানা।
- এই রঙ অমিলন্তি কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। আরো আছে!
- অ্যাঁ,বলো কী!!
- শোনো তবে। আমাদের রেটিনাতে কোন কোশগুলোর সামনে খুব ছোট ছোট তেলের বিন্দু আছে। তেলের এই বিন্দুগুলোর রঙ বিভিন্ন রকম হয় কারণ তাতে ক্যারোটিনয়েড নামক রঞ্জকের ঘনত্ব সমান হয় না। এই যে ক্যারোটিনয়েড রঞ্জক - সেগুলো বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোক রশ্মি শোষণ করে। অর্থাৎ তেলের বিন্দুগুলো আসলে আলোকরশ্মির ফিল্টার হিসেবে কাজ করে। আর তার ফলে আমাদের কোন কোশগুলো তোমাদের কোন কোশের থেকে আরও সূক্ষ্ম রঙের পার্থক্য ধরতে পারে। এই কারণে আমরা যেমন আমাদের স্ত্রী পুরুষ চিনতে পারি একইভাবে প্রজননে সক্ষম বা প্রজননে অক্ষম পাখি চিনতে পারি। আবার অনেক দূর থেকে কোনটা আমাদের শিকার আর কোনটা আমাদের শিকার নয়, কোনটা আমাদের খাদ্য আর কোনটা আমাদের খাদ্য নয়, কোথায় বিপদ আর কোথায় সম্পদ তা সহজেই বুঝতে পারি।
- বাপরে বাপ, তুমি তো দেখছি পাখিদের প্রফেসর।
- আরে না না, আমরা তোমাদের থেকেই তো জেনেছি। ওই যে তোমাদের তিনটে বাড়ি পরে ধৃতিমান থাকে না! ওতো ইউনিভার্সিটিতে জুলজি নিয়ে পড়ে। ওর পড়া আমি শুনেছি। সেখান থেকেই তো জানলাম ব্যাপারগুলো।
একটু দম নিয়ে বেনে বউ আবার বলল, আরো একটা অবাক করা ব্যাপার আমি জেনেছি, শুনবে?
- বলো বলো। প্রত্যয়ের কৌতুহল যেন মেটে না।
- তোমরা তো পরিযায়ী পাখিদের কথা জানো। ওরা বহুদূর থেকে, এমন কী পৃথিবীর এক মেরু থেকে আর এক মেরুতে পাড়ি দেয়। জানো, কী করে ওরা রাস্তা চিনতে পারে?
- শুনেছি পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র অনুসরণ করে নাকি চিনতে পারে। সঠিক জানি না।
- ঠিকই শুনেছো তুমি। কিন্তু কী করে চৌম্বক ক্ষেত্র বুঝতে পারে? সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা নাকি আবিষ্কার করেছেন পরিযায়ী পাখিদের চোখে ক্রিপটোক্রোম-৪ নামে একটি আলোকসুবেদী প্রোটিনের উপস্থিতি দেখা গেছে। নীল আলোর প্রতি এই প্রোটিন খুব সংবেদনশীল। নীল আলোর উপস্থিতিতে এই আলোকসুবেদী প্রোটিন তার গঠনের পরিবর্তন ঘটায়। আর তখনই তারা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র দেখতে পায়। কী দারুণ ব্যাপার, তাই না?
- অদ্ভুত সব ব্যাপার তোমাদের। তাহলে তো আমার মনে হয় আমাদের থেকে তোমরা বেশি উন্নত, অন্তত দৃষ্টিশক্তির ব্যাপারে।
- দেখো সেটা বিচার করার দায়িত্ব তোমাদের। আমাদের মগজ তো তোমাদের মতো অত উন্নত নয়। তবে এটুকু বলতে পারি আমাদের রেটিনাতে যে চার ধরনের কোন কোশ উপস্থিত তা হল জীবজগতের প্রাচীন বৈশিষ্ট্য। আর তিন ধরনের কোন কোশের উপস্থিতি হল আধুনিক বৈশিষ্ট্য।
- মানে? আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছো না তো?
- ধুৎ, ইয়ার্কি করব কেন? সত্যি কথাই বললাম। আমাদের মতো এই বৈশিষ্ট্য তো উভচর আর সরীসৃপদের মধ্যেও রয়েছে।
- তাই নাকি? যদি সত্যি তা হয় তাহলে আমাদের রেটিনাতে কোন কোশ কমে গেল কেন?
- প্রাণীদের বিবর্তনের ধাপে মানুষ তো সবার শেষে এসেছে। আসলে অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণীরা নিশাচর। এই নিশাচর বৈশিষ্ট্যই স্তন্যপায়ীদের চোখের রেটিনাতে অতিবেগুনি রশ্মির প্রতিফলন থেকে রঙ উপলব্ধি করার কোন কোশকে নষ্ট করে দিয়েছে। তাই তোমাদের চোখে রেটিনা থেকে সায়ান কোন কোশ হারিয়ে গেছে।
- ইস, থাকলে কী ভালো হত, তাই না?
- ভালো-মন্দ জানি না। জীবজগতে যা কিছু ঘটে তা প্রয়োজনের তাগিদেই ঘটে। তোমাদের প্রয়োজন নেই তাই নেই। আমাদের প্রয়োজন আছে, তাই আছে।
- সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু সত্যি করে বলো তো তুমি এত-শত জানলে কী করে? আমার কিন্তু ওই ধৃতিমানদার ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছে না।
মুচকি হেসে বেনে বউ বলল - তোমার স্কুলে জীবন বিজ্ঞান কে পড়ান?
- এইতো কথা ঘুরিয়ে দিচ্ছো।
- আরে বলোই না কে পড়ান?
- অপরাজিতা ম্যাম।
- ভালো করে তাকিয়ে দেখো তো আমার দিকে। একটু গভীরভাবে তাকিয়ে দেখো।
প্রত্যয় চোখ দুটো গোল গোল করে মুখটাকে জানালার কাছাকাছি নিয়ে গেল। তারপর সোজা তাকাল জানালার রডে বসা বেনে বউটার দিকে।
একী! এ তো বেনে বউ নয়! জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অপরাজিতা ম্যাম!! মুচকি হেসে ম্যাম ধীরে ধীরে উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল।
- ম্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যাম..... জোরে চিৎকার করে উঠল প্রত্যয়।
- কীরে! ম্যাম ম্যাম করে চেঁচিয়ে উঠলি কেন? প্রত্যয়ের চিৎকার শুনে তার মা ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে।
চোখ রগড়ে প্রত্যয় জানালা দিয়ে বাইরের দিকে কাকে খুঁজতে লাগল।
- কী রে! কাকে খুঁজছিস জানালা দিয়ে?
- অপরাজিতা ম্যাম, আমাদের জীবন বিজ্ঞান পড়াতেন। কী সুন্দর পড়াতেন ম্যাম। কী সুন্দর বুঝিয়ে দিতেন সবকিছু। একটু আগে এসেছিলেন। কতক্ষণ কথা হল। কিন্তু কোথায় গেলেন ম্যাম?
- কী উল্টোপাল্টা বলছিস? এইতো তুই গতকাল স্কুল থেকে ফিরে বললি তোদের স্কুলের যে দুজন ম্যাম সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরিহারা হয়েছেন তাঁদের মধ্যে অপরাজিতা ম্যামও আছেন। তুই তো বলেছিলি অপরাজিতা ম্যাম স্কুল থেকে যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন সবাই খুব কাঁদছিল। তাহলে উনি কোথা থেকে আসবেন আমাদের বাড়ির জানালায়? তুই স্বপ্ন দেখছিলি বাবা।
- না মা, আমি সত্যি বলছি। ম্যাম এসেছিলেন। বেনেবউ পাখির রূপ ধরে এসেছিলেন। কী সুন্দর করে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন মানুষ আর পাখির চোখে রঙ অমিলন্তির কারণ।
- তুই স্বপ্ন দেখছিলি বাবা।
- মা, ম্যাম কি আর কখনও আমাদের স্কুলে আসবেন না?
- আসবে বাবা নিশ্চয়ই আসবে। অপরাজিতা তো কখনো হারতে পারে না। মানুষ আর পাখির চোখে রঙ অমিলন্তি হতে পারে কিন্তু সমস্ত শুভ শক্তির রঙ মিলন্তি হবেই।