সূচিতে ফিরুন

গাছপালা কি বজ্রপাতে সাড়া দেয়

লেখক - ড.সৌমিত্র চৌধুরী

শুরু করতে হবে ‘করোনা’ দিয়ে। করোনা ভাইরাস নয় কিন্তু। করোনা শব্দটির অনেক মানে। মুকুটের মত দেখতে কোন বস্তুকেও বলে করোনা। সূর্যের চারদিকে যে আলোকছটা দেখা যায় (সূর্যগ্রহণের সময়), তার নাম করোনা। আমাদের দাঁতের উপর অংশের নামও করোনা। ‘করোনা’ নাম দিয়ে বহু বানিজ্যিক বস্তুও বিশ্ববাজারে ছেড়েছে অনেক কোম্পানি। আবার গাছের পাতা, তারও আছে করোনা। ‘বৃক্ষপত্রের করোনা!’ আশ্চর্য কথা বইকি। এর সঙ্গে আবার জড়িয়ে আছে অনেক কিছু। বজ্রপাত, মুক্তমূলক ইত্যাদি শব্দ।   img

মুক্ত মূলক, ইংরাজিতে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল (Free Radical) । হতে পারে অনু, পরমানু কিংবা আয়ন। তবে এর মধ্যে বিজোড় সংখ্যার ইলেকট্রন থাকতেই হবে। রসায়নশাস্ত্রের একটি বড় বিষয়, মুক্তমূলক বা ফ্রি র‍্যাডিক্যাল। জীববিজ্ঞানেও বহু চর্চিত।

ফ্রি-রেডিক্যালের আরেকটু পরিচয় দেওয়া যাক। ফ্রি-রেডিক্যাল শরীরে মুক্তভাবে চলাফেরা করে। এক প্রকার অতি সক্রিয় অণু এবং বিশেষ ক্ষমতাবান। কোষ ধ্বংস করে। কোষের ডিএনএ-এর মধ্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে পারে। তাই খুবই ক্ষতিকর। ফ্রি-রেডিক্যালের উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যায়, হাইড্রক্সিল আয়ন-এর কথা ।

অন্য ভাবেও সংজ্ঞায়িত হতে পারে। বিজোড় ইলেকট্রন সম্বলিত যে কোনও প্রজাতির নাম ফ্রি র‌্যাডিকেল। বাংলায় ‘মুক্ত পরমাণুজোট’। যেসব পরমাণুগুচ্ছ স্বাধীনভাবে না থেকে মৌলিক পদার্থের পরমাণুর মতো যৌগ গঠনে অংশ নেয়, তারাই ফ্রি র‌্যাডিক্যাল (Free Radical) ।

দিস্তা দিস্তা কাগজ লেখা দিয়ে ভরিয়ে তুললেও শেষ করা যাবে না ফ্রি র‌্যাডিক্যাল কথন। বহু রকমের এবং বহু ধরনেরে কার্যাবলী এদের। হাইড্রক্সিল ফ্রি র‌্যাডিক্যালের কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও আছে অক্সিজেন ফ্রি র‌্যাডিক্যাল , হাইড্রোপারঅক্সিল, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ইত্যাদি। কী ভাবে কাজ করে এরা? কোষের নিউক্লিয়াসে ঢুকে বিভিন্ন সিগন্যাল পাঠায়। জিনের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। বিষয়টি নিয়ে বহু গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। লেখা হয়েছে অনেক বইও। একটি বইয়ের কথা উল্লেখ করা হল  (Signalling Mechanisms — from Transcription Factors to Oxidative Stress, Springer publication, 1995; Editors: Lester Packer, Karel W. A. Wirtz)।কোষের নিউক্লিয়াসে ঢুকে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল বিভিন্ন সিগন্যাল পাঠায়। ফলে উদ্দিপ্ত হয় বিভিন্ন কাইনেস অনু। কাইনেস কোনও প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাকে দ্রুত ক্রিয়াশীল করে দেয়। ফলে শুরু হয় একের পর এক ঘটনা। শরীরের বিভিন্ন যন্ত্রে রোগ, দ্রুত বার্ধক্য, এমনকি ক্যান্সারও।

প্রতিহত করবার উপায়? ক্রিয়াশীল ফ্রি র‍্যাডিক্যালকে শরীরের মধ্যে প্রশমিত করে ফেলা। বিশেষ কিছু খাদ্য, ফল এবং সব্জি গ্রহণের মধ্য দিয়ে এমনটা করা সম্ভব। ফলের মধ্যে থাকে অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট, ফ্ল্যাভন জাতীয় অনু। এরা অক্সিজেন ফ্রি র‍্যাডিক্যালকে প্রশমিত (quench) করে দিতে পারে। শরীর সুস্থ রাখবার সহজ এক উপায় এটি।

শরীরের সব ধরণের কোষে মুক্ত মুলকের প্রভাব বহু আলোচিত। অসংখ্য রোগ সৃষ্টি করে ফ্রি র‍্যাডিক্যল। দুনিয়া জুড়ে গবেষণা চলছে। আমরাও গবেষণা করেছি ফ্রি র‍্যাডিক্যাল, অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট এবং সিগন্যাল প্রবাহ নিয়ে। একটি মাত্র গবেষণা পত্র উল্লেখ করলাম (A novel tin based hydroxamic acid complex induces apoptosis through redox imbalance and targets Stat3/JNK1/MMP axis to overcome drug resistance in cancer, K. Bannerjee, S K Choudhuri et al, Free Radical Research, Free Radical Research 55, 2021, 9-10)।  

এত কথা বলা হল কেন? অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট, ফ্রি রেডিক্যালের প্রভাব কী শুধু জীববিজ্ঞান, শরীরতত্ত্ব আর ওষুধশাস্ত্রেই সীমাবদ্ধ? এমনটা নয় কিন্তু। প্রকৃতির বহু ঘটনায় জড়িয়ে আছে ফ্রি রেডিক্যাল বা মুক্তমূলক। প্রকৃতির কোন্‌ ঘটনা? আমাদের আলোচনা প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত নতুন একটি প্রশ্ন নিয়ে। কী প্রশ্ন? বৃক্ষের সঙ্গে বজ্রপাতের কি কোন সম্পর্ক আছে?

আছে। বহুকাল আগেই গোচরে এসেছিল একটি বিষয়। গাছপালা বজ্রপাতে সাড়া দেয়। বজ্রপাতের নেপথ্যে কাজ করে বহু বিষয়। বিশ্ব উষ্ণায়ন, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও অন্য গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি ইত্যাদি। বর্তমান আলোচনা সেই বিশেষ প্রশ্নটি নিয়ে।

বিদ্যুতক্ষেত্রের প্রভাবে বিশেষ কিছু কর্ম সম্পাদন করে বৃক্ষকুল। কেমন সেই কর্ম? উঁচু মানের বিদ্যুৎক্ষেত্রের সম্মুখীন হলে গাছ থেকে বিকিরিত হয় (স্পার্ক) তড়িৎকণা। অর্থাৎ পরিবেশে বিদ্যুৎ (চার্জ) ছড়িয়ে দেয় বৃক্ষরাজি। এই বিদ্যুৎ স্পার্কের নাম করোনা।

কী হয় এর ফলে? ঘটে অনেক কিছু। গাছপালার বিদ্যুৎ ছড়িয়ে দেওয়া বিষয়টি নিয়েই এখনকার আলোচনা।

বজ্রপাতের সময় অথবা গবেষণাগারে শক্তিশালী বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের অধীনে গাছকে স্থাপন করলে, বৃক্ষ নিঃসরণ করে বৈদ্যুতিক চার্জ (করোনা)। কী ঘটে তার ফলে?

ঘটে অনেক কিছু এবং ঘটনার ফল সুদূর প্রসারী। উঁচু মানের বিদ্যুৎ প্রবাহের সম্মুখীন হলে বৃক্ষ থেকে নির্গত হয় হাইড্রক্সিল (hydroxyl, OH.) এবং হাইড্রোপারক্সিল (Hydro peroxyl.) নামের দুই ধরণের র‍্যাডিক্যাল। র‍্যাডিক্যাল অতি দ্রুত বিক্রিয়া করতে সক্ষম। মুহূর্তেই বস্তুর রাসয়নিক পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়।

হাইড্রক্সিল (hydroxyl, OH.) আর হাইড্রোপারক্সিল, এই দুই ধরণের র‍্যাডিক্যালই ঋণাত্মক (Negative)। অন্য পদার্থ থেকে ইলেকট্রন গ্রহণ করে নিজেরা বিজারিত হয়ে যায় এবং অন্যকে জারিত করে। অর্থাৎ ইলেকট্রন গ্রহণ এবং বর্জন কাজের মধ্য দিয়ে দাতা এবং গ্রহিতা উভয় পদার্থই তড়িৎ বিহীন অনুতে পরিণত হয় যায়।

প্রকৃতিতে এর প্রভাব অনেক। বাতাসে উপস্থিত দূষণকারী পদার্থকে জারিত করে দেয় হাইড্রক্সিল রেডিক্যাল। বায়ুমণ্ডলের গ্যাসকে জারিত করবার মুল কাজটাই সম্পন্ন করে হাইড্রক্সিল রেডিক্যাল।

বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি করে গ্রিনহাউস গ্যাস (যেমন, কার্বনডাই অক্সাইড, মিথেন, জলীয় বাস্প)। এখন প্রশ্ন, হাইড্রক্সিল রেডিক্যাল যখন বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধিকারী গ্রিনহাউস গ্যাসকে জারিত করে? ধরা যাক গ্রিনহাউস গ্যাসটি মিথেন। জারিত হয়ে দূষণ সৃষ্টিকারী মিথেন বাতাস থেকে অপসারিত হয়ে যাবে। এই প্রক্রিয়ায় বায়ুদূষণ রোধ বা উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হতে পারে।

আবার উল্টো ভাবে, এই র‍্যাডিক্যাল বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেনের সঙ্গে যদি বিক্রিয়া করে? তখন তৈরি হবে ওজোন গ্যাস। বাতাসের উপরিভাগে এর বড় ভূমিকা আছে। মানুষের শরীরে এর বিরূপ প্রভাব। এয়ারোসল তৈরি করে বায়ু দূষণকেও বাড়িয়ে দেবে।

বায়ুমণ্ডলের গ্যাস গুলিকে জারিত করবার বেশিরভাগ কাজটাই সম্পাদন করে হাইড্রক্সিল র‍্যাডিক্যাল। আর বাতাসে অতিরিক্ত মাত্রার হাইড্রক্সিল র‍্যাডিক্যালের উপস্থিতি ডেকে আনে ঘন ঘন বজ্রপাত। বায়ু দূষণের ছয় ভাগের এক ভাগের জন্য দায়ী বায়ুমণ্ডলে হাইড্রোক্সিল র‍্যাডিক্যালের উপস্থিতি।  

বাতাসকে দূষণ মুক্ত রাখে হাইড্রক্সিল রেডিক্যাল। ঘন ঘন বজ্রপাতের দরুন বৃক্ষ থেকে নির্গত হয় এই হাইড্রক্সিল রেডিক্যাল। ব্যাপক অনুসন্ধান জানান দিয়েছে তথ্যটি। বাতাস যত দুষিত, যত বেশী বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের উপস্থিতি, ততই ঘন ঘন ঘটে বজ্রপাত।

  বজ্রপাত আর বৃক্ষ থেকে করোনা নিঃসরণ, এই দুটি বিষয়ের সম্পর্ক অতি গভীর। হাইড্রক্সিল রেডিক্যাল কি বাতাসের দূষণ নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক উপায়? অন্যভাবে দূষণ মুক্ত বাতাস কি ঘন ঘন বজ্রপাত থেকে ধরিত্রীকে রক্ষা করতে সক্ষম? বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন অনেক। গবেষণাও চলছে নিরন্তর। সব প্রশ্নের উত্তর এখনও অধরা।

বিষয়টি নিয়ে গবেষণা চলেছে (Electric Discharge from Plants May Be Changing Air Quality in Ways We Didn't Expect, NATURE 22 October 2022)। কয়েক মাস আগে আরও উল্লেখযোগ্য তথ্য জানিয়েছেন আমারিকার বৈজ্ঞানিক ব্রুনে। [Prodigious Amounts of Hydrogen Oxides Generated by Corona Discharges on Tree Leaves, J. M. Jenkins,G. A. Olson,P. J. McFarland, D. O. Miller,W. H. Brune, JGR Atmosphere, 09 August 2022।]

বিষয়টি জটিল এবং বহু প্রশ্নের উত্তর এখনও অধরা। তবে বায়ু দূষণের সঙ্গে বজ্রপাতের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, সেই বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।   

চিত্রসূত্র – ইন্টারনেট