
আজ লিখতে বসেছি সপ্তদশ শতাব্দীর এক মহিলা প্রকৃতিবিদের কথা, যিনি বিভিন্ন পতঙ্গ ও উদ্ভিদের ওপর পর্যবেক্ষণ করেছিলেন এবং তা লিপিবদ্ধ করে বই আকারে প্রকাশ করেছিলেন। বিভিন্ন প্রাণী সম্পর্কে জানার জন্য তিনি সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় ও ব্যয়ে ভ্রমণ করেছিলেন এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে। তাঁর জীবদ্দশায় বিজ্ঞানী হিসেবে সেভাবে স্বীকৃতি না পেলেও এই একবিংশ শতাব্দীতে তাঁর করে যাওয়া কাজ বিজ্ঞানী মহলে স্বীকৃতি পাচ্ছে। তাঁর ৩৫০ বছরের জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে গত ১৯৯৭ সালে নেদারল্যান্ডের আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সেই উপলক্ষে প্রকৃতিবিজ্ঞানে তাঁর অবদান নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে বিজ্ঞানীমহলে।
এই প্রকৃতিবিদের নাম মারিয়া সিবিলা মেরিয়ান (Maria Sibylla Merian)। তাঁর জন্ম ১৬8৭ খ্রিস্টাব্দের ২ এপ্রিল জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে। তিনি আজ থেকে প্রায় চার শতাব্দী আগে বিভিন্ন পতঙ্গের জীবনচক্র পর্যবেক্ষণ করেছেন, তা লিপিবদ্ধ করেছেন এবং অপূর্ব সুন্দর চিত্রের সাহায্যে নথিবদ্ধ করেছেন। তিনি বিভিন্ন ওষধিগুণ সম্পন্ন উদ্ভিদের সন্ধানও করেছেন। বিভিন্ন উভচর প্রাণীর জীবনচক্রও চিত্র সহযোগে নথিবদ্ধ করেছেন। তাঁর কাছে ছিল না কোনো অণুবীক্ষণ যন্ত্র। শুধুমাত্র খালি চোখে পর্যবেক্ষণ করে আশ্চর্য সুন্দর চিত্র অঙ্কন, কখনও বা তামার পাতে খোদাই করে তাঁর পর্যবেক্ষণ রেখে গেছেন পরবর্তী যুগের বিজ্ঞানীদের জন্য। একটি তামার পাতে খোদাই করা তাঁর কাজে দেখা যাচ্ছে, একটি পেয়ারা গাছের ডালে একটি বিশালাকার মাকড়সা একটি পাখিকে ভক্ষণ করছে। আশেপাশে রয়েছে পিঁপড়ে ও আরশোলা। এঁকেছেন বিভিন্ন ব্যাঙ, সাপ, মাকড়সা, ইগুয়ানা, ট্রপিক্যাল বীটল্ , গাছ প্রভৃতির ছবি। তিনি দেখেছিলেন, একপ্রকার শূঁয়োপোকা শুধুমাত্র একধরনের গাছের পাতাই খায়, যার অভাবে তারা মারা যায়। তবে কোনো কোনো শূঁয়োপোকা অন্য গাছও খায়, তাদের পছন্দের গাছের অভাবে।
ছোটবেলা থেকেই মারিয়ার আগ্রহ ছিল প্রজাপতির জীবনচক্র সম্পর্কে। কীভাবে ডিম থেকে শূঁয়োপোকা, তা থেকে পিউপা হয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতির জন্ম হচ্ছে, এই বিষয়টি তাঁকে খুব আগ্রহী করে তুলত। এই পর্যবেক্ষণে তিনিই Pioneer বলা যেতে পারে। বাড়িতেই বিভিন্ন রকম শূঁয়োপোকা বা প্রজাপতি ও মথের লার্ভা সংগ্রহ করে তাদের ক্রমপরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করতেন তিনি।
১৬৭৯ সালে এ ব্যাপারে তাঁর প্রথম বৈজ্ঞানিক পুস্তক প্রকাশিত হয় যার নাম ইংরেজিতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় 'The wondrous transformation of caterpillars and their remarkable diet of flowers'। এই বইয়ের প্রথম ভাগে ৫০টি ছবির প্লেট ছিল তাঁর নিজের হাতে তৈরি করা। দ্বিতীয় ভাগটি প্রকাশিত হয় ১৬৮৩ সালে। ১৬৮৫ সালে তিনি নেদারল্যান্ডে যান ইউরোপীয়ান মথ ও প্রজাপতি নিয়ে গবেষণা করার জন্য।
ট্রপিক্যাল দেশের পতঙ্গদের জীবনচক্র এবং তার বিভিন্ন পর্যায়ের ক্রমপরিবর্তন (metamorphosis) পর্যবেক্ষণে তিনিই ছিলেন প্রথম বিজ্ঞানী। বিভিন্ন দেশের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণকারী ও সেই উদ্দেশ্যে দেশ ভ্রমণকারী হিসেবে পুরুষদেরই প্রাধান্য দেখা গেছে। কিন্তু এই ব্যাপারেও ব্যতিক্রমী পথিকৃৎ মারিয়া। তিন শতকেরও বেশি আগে ১৬৯৯ সালে মারিয়া ৫২ বছর বয়সে নিজের এক কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ি দিলেন দক্ষিণ আমেরিকার সুরিনামে। সেখানে তিনি ছিলেন ২১ মাস। এই সময়থর মধ্যে তিনি বিভিন্ন প্রজাপতি ও মথের শূঁয়োপোকা এবং তেদের বসবাসের গাছপালা সংগ্রহ করেন। এই কাজে তাঁকে সাহায্য করেন তাঁর কন্যা এবং সুরিনামে বসবাসকারী কিছু ভারতীয় ও কৃষ্ঞাঙ্গ ক্রীতদাস। সেখানে তখন আখের চাষ বেশি হত। ঐসব আখক্ষেতের ডাচ্ মালিকরা তাঁকে কোনো সাহায্য করেননি। সংগৃহীত শূঁয়োপোকা ও তাদের বসবাসের উদ্ভিদগুলিকে তিনি বাড়িতে এনে কাঠের বাক্সতে রেখে পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি যখন হল্যান্ডে ফিরলেন তখন তাঁর সঙ্গে প্রচুর প্রাকৃতিক 'স্পেসিমেন' এবং নোটবই ভর্তি তথ্য। এবার তিনি শুরু করলেন তাঁর পর্যবেক্ষণ করা জীবনচক্রের বিভিন্ন দশার চিত্র অঙ্কন ও খোদাই এর কাজ। এগুলিই ছিল দক্ষিণ আমেরিকার পতঙ্গজগৎ এবং ফুল ও ফলগাছ সম্পর্কে পরথম বিবরণী। ১৭০৫ সালে বিপুল তথ্যসমৃদ্ধ বই 'Metamorphosis Insectorum Surinamensium' প্রকাশিত হয়, যাতে ছিল ৬০ টি চিত্রসমৃদ্ধ প্লেট। এই বই তাঁকে প্রকৃতিবিদ ও শিল্পসংগ্রাহক মহলে বিখ্যাত করে তোলে। বইটির পাঁচটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তবে প্রথম সংস্করণ ছাড়া অন্যগুলি প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পরে।
সুরিনামের উভচর ও সরীসৃপদের নিয়েও তিনি কাজ করেছিলেন। তবে বই আকারে তা প্রকাশিত হয়নি। তাঁর এই বিষয়ের আঁকাগুলি রক্ষিত আছে সেন্ট পিটার্সবার্গের একাডেমি অফ সায়েন্সেস-এ।তাঁর "Caterpillar books" -এর প্রথম দুটি খন্ড তিনি ডাচ্ ভাষায় অনুবাদ করেন এবং ১৭১৩ ও ১৭১8 খ্রিস্টাব্দে সেগুলি প্রকাশিত হয়। ১৭১৫ সাল অবধি তিনি কর্মক্ষম ছিলেন। ওইবছর তাঁর স্ট্রোক হয়। তারপর দুই বছর তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় বেঁচে ছিলেন। ১৭১৭ সালের ১৩ ই জানুয়ারি আমস্টারডামে নিজের বাড়িতে তাঁর মৃত্যু হয়।
তাঁর মৃত্যুর অল্প পূর্বে রাশিয়ান ডাক্তার রবার্ট আর্সকাইন (Robert Erskine) (যিনি ছিলেন তৎকালীন জার পিটার দ্য গ্রেট-এর চিকিৎসক) মারিয়ার আঁকা কিছু ছবি বহুমূল্যে ক্রয় করেন। এই সংগ্রহই বর্তমানে রয়েছে সেন্ট পিটার্সবার্গে। এর মধ্যে আরও আছে মারিয়ার "Book of notes and studies"।
তবে মারিয়া যেহেতু জীববিজ্ঞানী ছিলেন না, তাই তিনি সংগৃহীত প্রাণী বা উদ্ভিদের ছবিতে তাদের নাম দেননি। তিনি যা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, হুবহু তাই আঁকা Plate-এ তুলে ধরেছিলেন। কিন্ত পরবর্তীকালে লিনিয়াস ওই ছবিগুলি থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। তাই মারিয়ার আঁকাগুলিকে অবশ্যই বৈজ্ঞানিক চিত্র বলেই ধরতে হবে।
বিংশ শতাব্দী থেকে তাঁর কাজের মূল্যায়ণ শুরু হয়েছে। আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫ জন বিজ্ঞানীর নামের তালিকার ফলকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাঁর নাম। জার্মানীর পূর্বতন মুদ্রায় ছাপা হত তাঁর ছবি, ইউরো প্রচলিত হবার আগে। ১৯৮৭ সালে তাঁর ছবি সম্বলিত একটি স্ট্যাম্প প্রকাশিত হয়। ২০০৫ সালে জার্মানীর একটি গবেষণা তরীর নাম ছিল R.V. Maria S.S. Merian। ২০১৩ সালের ২ এপ্রিলের গুগল্ ডুডল্ টি ছিল তাঁকে নিয়ে তাঁর ৩৬৬ তম জন্মবার্ষিকীতে।
তাঁর নামে তিনটি প্রজাপতির নামকরণ হয়েছে ( Opsiphanes cassina merianeae), একটি Subspecies এর নাম হয়েছে Heliconius melpomene meriana। ২০১৮ তে একটি দুর্লভ প্রজাপতির নাম হয়েছে Catasticta sibyllae (পানামা)। কিউবার একটি মথের নাম হয়েছে Erinnyis merianae। মাকড়সার ওপর তাঁর গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ পাখিভুক মাকড়সার নাম হয়েছে Avicularia merianeae। অপর একটি মাকড়সার নাম Metallina merianae (২০১৭)। আর্জেন্টিনার সরীসৃপের নাম Salvator merianeae, ব্যাঙের নাম Rhinella merianae, শামুকের নামCoquandiella meriana ।
এইসব তথ্য থেকে আমরা বলতেই পারি যে, তাঁর সময়ে তিবি বিজ্ঞানী হিসেবে সেভাবে স্বীকৃতি না পেলেও বর্তমানে বিজ্ঞানজগৎ তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছে।