
প্লাস্টিক আমাদের জীবনে কিরূপ ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলেছে তা আজ কারোর আর অজানা নেই। আর্কটিক, হিমালয় পর্বত, মাতৃদুগ্ধ থেকে আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে এখন মাইক্রো প্লাস্টিক এর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি মিনিটে একটি লরির সমান প্লাস্টিক বর্জ্য আমাদের সমুদ্র গুলিতে নিক্ষেপিত হয়।
দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে ২৫ শে নভেম্বর 202৪ থেকে ১ লা ডিসেম্বর অবধি প্লাস্টিক দূষণ রোধ করা নিয়ে একটি অন্তর্দেশীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। লক্ষ ছিল প্লাস্টিক দূষণ রোধ করা তথা প্রতিনিয়ত যে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক আমাদের জমিজমা ও নদী নালার শ্বাসরোধ করছে, তাকে আটকানো নিয়ে একটি আইনত বাধ্যতামূলক চুক্তিতে উপনিত হওয়া। এটি প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে জাতিসংঘের পঞ্চম বৈঠক ছিল (INC 5)। প্রায় ১০০০ দিন আগে থেকে এই বৈঠকের মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কথা স্থির হয়ে ছিল। কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মেক্সিকো অস্ট্রেলিয়া কে নিয়ে গঠিত ৩৮ টি দেশের সমন্বয় বা হাই ambition কোয়ালিশন (HAC), ২০৪০ এর মধ্যে প্লাস্টিক জনিত দূষণ সম্পূর্ণ ভাবে রোধ করার লক্ষ্য নিয়ে রচিত যে কোনো চুক্তির পক্ষে ছিল। HAC র মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ যে সমস্ত দেশগুলি অধিক প্লাস্টিক উৎপন্ন করে, বিশ্ব অর্থনীতিকে প্লাস্টিক নির্ভরতা থেকে সরিয়ে আনার মূল দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে।
প্লাস্টিকের জীবনচক্র যদি আমরা দেখি, তাহলে এর মূলত তিনটি স্তর আমরা দেখতে পাবো, উৎপাদন , পুনরব্যাবহার ও নিষ্কাশন। প্লাস্টিক উৎপাদনের ঊর্ধ্বসীমা নির্ণয়, ক্ষতিকারক বর্জ্য ও রাসায়নিকের ওপর নিয়ন্ত্রণের সাথে সাথে, প্লাস্টিকের জীবনচক্রের প্রতিটি পর্যায় নিয়ন্ত্রিত করার পূর্ণ রূপরেখা তৈরির কথা ছিল বুসানে আলোচনা রত দেশগুলির।
প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে যে কোনও আন্তর্জাতিক চুক্তি সফলভাবে প্রয়োগের জন্য চাই, প্লাস্টিক উৎপাদনের ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ, প্লাস্টিক উৎপাদনের জন্য দূষণকারী বা হানিকারক রাসায়নিকের প্রয়োগের ওপর নিষেধ আজ্ঞ্য
এবং এই নিয়মগুলি সর্বত ভাবে লাগু করার জন্য ব্যাতিক্রমী পদ্ধতি প্রয়োগের জন্য পর্যাপ্ত অর্থের যোগান।
যে কোনও আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে আইনি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে মুশকিল হচ্ছে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর ভিটো পাওয়ার। অধিকাংশ দেশ কোনও চুক্তির বিষয়ে সম্মত হলেও যে কোনো একটি দেশ ভিট পাওয়ার প্রয়োগ করে তা রোধ করে বা আটকে দিতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান এও সেই একই সমস্যা দেখা গেছে। এটি প্লাস্টিক দূষণ রোধ নিয়ে শেষ বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আলোচনারত দেশগুলি প্লাস্টিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোনও ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। শেষমেশ তাঁরা ভবিষ্যতেও আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বৈঠকের পরিসমাপ্তি ঘটান। প্রতিনিধিরা ঠিক করেন যে, 2025 এ তাঁরা পুনরায় আলোচনায় বসবেন, (সম্ভবত বৈঠকের নামকরণ হবে আইএনসি 5.2), আইনত বাধ্যতামূলক চুক্তি চূড়ান্ত করতে, যা কিনা লাগু হবে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধি দেশগুলির ক্ষেত্রে। অধিকাংশ দেশগুলি প্লাস্টিক উৎপাদন কম করা, প্লাস্টিক উৎপাদনের জন্য দূষণকারী বা ক্ষতিকারক রাসায়নিকের ব্যবহার বন্ধ করার পক্ষে রায় দিলেও জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশগুলি চুক্তির এই বৃহৎ আঙ্গিকে রাজি হয়নি। তারা চুক্তিকে সিঙ্গল উসেদ প্লাস্টিক বা একক ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছেন। তারা প্লাস্টিক উৎপাদন কম করার চেয়ে, প্লাস্টিক বর্জ্যের নিয়ন্ত্রণহীনতার জন্য যে দূষণ, তার উপর জোর দেওয়ার কথা বলেছেন। তাদের মতে প্লাস্টিক উৎপাদন নয়, প্লাস্টিক বর্জ্যের উপর নিয়ন্ত্রণহীনতাই এ ক্ষেত্রে মূল সমস্যা। তাঁরা এটাও বলেছেন যে, যেহেতু পৃথিবীর জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান, তাই প্লাস্টিকের চাহিদাও বৃদ্ধি পাবে। অতএব প্লাস্টিকের উৎপাদন কম করা যাবে না।
কিন্তু একটি ব্যাপার ভুলে গেলে চলবে না যে প্লাস্টিক রিসাইকেল করা খুব একটা সহজসাধ্য কাজ নয়। আমরা রোজ সকালে যে মাজন দিয়ে দাঁত মাজি, তাঁর প্লাস্টিক টিউব কোথায় যায় তা আমরা জানি না। নিজেদের সুবিধার জন্য আমরা যে কত ভাবে দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার করি তা আমরা নিজেরাই বোধহয় অনুধাবন করতে পারি না। এখন আমাদের গায়ে মাখার সাবান, হাত ধোয়ার, কাপড় কাচার সাবানও আসে প্লাস্টিকের সুন্দর সুন্দর বোতলে। কেউ আমরা কখনও ভেবে দেখিনি কোথায় শেষ পর্যন্ত যায় এই বোতলগুলি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মোটে নয় শতাংশ রিসাইকেল করা সম্ভব হয়। উন্নতিশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে এই হার আরো অনেক কম। এই নয় শতাংশ রিসাইকেল প্লাস্টিক সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনের বহুগুণ কম। প্লাস্টিক রিসাইক্লিং অত্যন্ত খরচ সাপেক্ষ এবং জটিল পদ্ধতি। প্রত্যেক বছর সারা বিশ্বে আমরা প্রায় চারশো তিরিশ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক উৎপন্ন করি। প্লাস্টিকের উৎপাদন বিগত দু দশক হু হু করে বেড়েছে। আমরা যদি সঠিকভাবে প্লাস্টিকের ব্যবহার তথা উৎপাদন রোধ করতে না পারি তাহলে 2060 সালের মধ্যে প্লাস্টিকের উত্পাদন বর্তমানের থেকে তিনগুণ বৃদ্ধি পাবে। 2015 র নিরিখে 2040 এর মধ্যে প্লাস্টিকের উৎপাদন আড়াই গুন বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং প্লাস্টিকজনিত দূষণ রোধ করার অন্যতম পন্থা হচ্ছে প্লাস্টিকের উৎপাদন কমানো। এর সাথে সাথে প্লাস্টিকের পণ্য এমনভাবে নকশা করতে হবে যাতে তা সহজেই পুনর্ব্যবহারযোগ্য হয়। বিশ্বের ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জগুলি উন্নতশীল দেশগুলি এই প্লাস্টিকের দূষণদ্বারা সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত। যদিও প্লাস্টিক দূষণে তাঁদের অবদান সব থেকে কম। বিশ্বের প্লাস্টিক বর্জ্যের মাত্র 1.3 শতাংশের জন্য এই দ্বীপগুলি দায়ী হলেও, তাদের ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য, দ্বীপপুঞ্জগুলিকে শুধু যে নিজেদের বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তাই নয়, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির প্লাস্টিক বর্জ্যও এদেরকে সামাল দিতে হয়। এই দ্বীপগুলির ও পৃথিবীর পিছিয়ে থাকা দেশগুলির ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্র ও জনস্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের ব্যবহার যথাশীঘ্র রোধ করা অতি আবশ্যক।
আশ্চর্যের বিষয় হল, জীবাশ্ম জ্বালানি ও রাসায়নিক শিল্পের বহু লবিস্ট এই সম্মেলনে যোগ দেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের থেকে এদের সংখ্যাই বেশি ছিল। স্বভাবতই পরিবেশবিদদের মতে, এই লবিস্টদের বুসানের সম্মেলনে যোগদান চূড়ান্ত বিতর্কিত। এই লবিস্ট রা তাদের আর্থিক মুনাফা কে মানুষের সুস্থতার থেকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। সম্মেলনে এরা যে শুধুমাত্র প্লাস্টিক উৎপাদনের ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণে বাধা দিয়েছেন তাই নয়, প্লাস্টিক তৈরিতে যে হানিকারক রাসায়নিক ব্যবহৃত হয় তার প্রয়োগেও নিষেধাজ্ঞা জারি করতে দেননি। প্লাস্টিক শিল্পের সাথে জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের সরাসরি যোগাযোগ আছে। 99% প্লাস্টিকে উৎপন্ন হয় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। বিকল্প শক্তি বা জ্বালানির ব্যবহার ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী কোম্পানি বা দেশগুলোর মুনাফার অন্যতম রাস্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই প্লাস্টিক শিল্প।
এখন আমাদের 2025 এর সম্মেলনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। বর্তমান সম্মেলনে অধিকাংশ দেশই ঠিক করে যে, যে কোনো যুক্তি যা ক্ষতিকারক রাসায়নিকের ব্যবহার ও পণ্যের উৎপাদন, পর্যায়ক্রমিক হ্রাস ও পরিশেষে নিষেধাজ্ঞা জারি করবে না, তারা সেই চুক্তির বিরোধিতা করবেন। সম্মেলনের শেষে খসড়াটি বর্তমানে আলোচিত বিবেচিত হচ্ছে, তাতে কিছু নিষেধাজ্ঞার উল্লেখ থাকলেও, অনেকেই তাকে প্লাস্টিক দূষণ রোধে পর্যাপ্ত বলে মনে করছেন না। কিন্তু আমরা এর আগে পরিবেশ বা জল ও বায়ু দূষণ রোধে সম্মিলিত সদর্থক পদক্ষেপ যে নিই নি তা নয়। 1987 সালের মন্ট্রিয়াল প্রোটোকলে ওজন লেয়ার ছিদ্রকারী প্রায় একশোটি রাসায়নিকের উৎপাদন ও ব্যবহারের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা হয়। এখন দেখা যাক যে 2025 সালের আগত সম্মেলনে আমরা এ রকম কোনও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ নিতে পারি কি না।