সূচিতে ফিরুন

গবুদাদুর গুপ্ত গবেষণাগার

লেখক - অবন্তী পাল
img

গবুদাদু যখন নিরুদ্দেশ হলো, আমি তখন নবম শ্রেণীতে পড়ি। আমাদের পাশের গ্রামের শেষপ্রান্তে, যেখান থেকে শালবন শুরু হয়ে নিজের নিবিড় গহীনে আড়াল করেছে বিদ্যাধরীর গতিপথ, ঠিক সেইখানে গবুদাদুর বাড়ি। সে এক পেল্লায় বড় বাড়ি। কত যুগ আগের যে ওই পুরোনো বাড়ি, তা আমরা কেউ ঠাহর করতে পারি না। গড়ন দেখে মনে হয়, এ বাড়ি নিশ্চয়ই ব্রিটিশ আমলে তৈরি। কিন্তু বহুকালের অযত্নে তার আজ ভগ্নদশা উপস্থিত। চারদিকে আগাছা, বিশাল থাম ভেদ করে দেওয়াল বেয়ে উঠে এসেছে সহস্র লতানো গাছ-গাছালি। দোতলা বারান্দার একটা দিক ভেঙে ঢুকেছে অশ্বত্থ গাছের ডালপালা। হুট করে দেখলে মনে হবে বুঝি বাড়ির চারপাশের জঙ্গল নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে!

শেষপ্রান্ত বলতে আমরা আমাদের স্কুলের ভূগোলের মাষ্টারমশাই, শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ ধরের বাড়িটাই ধর্তব্যের মধ্যে ধরতাম। মাষ্টারমশায়ের বাড়ি ছাড়িয়ে আরো কিছুদূর গেলে তবে পড়ে গবুদাদুর বাড়ি। সে একেবারেই লোকালয়ের বাইরে। অতদূর আমরা যাব অন্ধকার জঙ্গলের আশেপাশে, এমন বুকের পাটা আমাদের কারুর ছিল না। তাই বাড়িটা দেখে আমরা দূর থেকেই কৌতূহল নিবারণ করতাম, ধারেকাছে যাওয়ার সাহস পেতাম না। কিন্তু সবাই জানতাম এই কঙ্কালসার বাড়ির মধ্যে গবুদাদু থাকে। কীভাবে যে থেকে, কেন যে বাড়ি সংস্কার না করিয়ে দিনের পর দিন ওইভাবে থাকে, তা আমরা কেউ বলতে পারি না। দূর থেকে এক দুই দিন দেখেছিলাম, কড়া আলোয় দেখা যায় জানলার ধারে গবুদাদুর সিলুয়েট। হাতে কিছু না কিছু যন্ত্রপাতি ধরা থাকত। বুঝতাম, দোতলার বারান্দার উল্টোদিকের ঘরে গবুদাদুর গবেষণাগার। ওহ, বলতেই ভুলে গেছি, গবুদাদুর আসল নাম শ্রীমান মণিশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। জ্ঞানী গুণী গবেষক মানুষ হওয়ার কারণে, আমরা সবাই গবেষকদাদু বলে ডাকতাম। কবে যে সেটার অপভ্রংশ হয়ে গবুদাদু হয়ে গেল, কে জানে?

রাস্তাঘাটে কখনো-সখনো দূর থেকে আমরা দাদুকে দেখেছি। দেখেছি যন্ত্রপাতি নিয়ে ওই বাড়ি থেকে বের হতে বা ঢুকতে। সাদা ধবধবে কোঁকড়ানো চুল মাথায়, চিবুকস্পর্শী লম্বা সাদা গোঁফদাঁড়ি আর সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত গুরুগম্ভীর মানুষটা যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেত, খানিকটা ভয় আর অনেকখানি শ্রদ্ধা মিশে আমাদের মাথা এমনিই নুয়ে পড়ত। অত বুদ্ধিদীপ্ত চোখের দিকে তাকাবে কার সাধ্য? দাদু মনে হয় আমার মনের কথা বুঝতে পারত। এই যে, একটু দাদুর কাছে ঘেঁষতে চাই, রকমারি গবেষণার গল্প শুনতে চাই, দেশ-বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা জানতে চাই, আমার মস্তিষ্কের সেইসব সুপ্ত ইচ্ছা কেমনভাবে যেন পড়ে ফেলত। তাই না হলে কি আর সেদিন রাস্তায় আমাকে ডেকে বলত,

“নীরেন্দ্রনাথ, রোববার সক্কাল-সক্কাল তোর বন্ধুদের সাথে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে আসিস।”

বন্ধুবান্ধব বলতে খগেন, পুকাই, ভজা আর আমি। শালবনের ধারে ওই ভগ্ন বাড়িতে যাব? তার চাইতে স্কুলের মাঠে অথবা রায়দীঘির পাড়ে গল্পের আসর জমালে হয় না? তাতে আপত্তি থাকলে অন্তত শিবমন্দিরের পাশে অশ্বত্থতলায়? ঢোক গিলে আমতা আমতা করছি, ঠিক কীভাবে কথাটা বোঝাব ভাবছি, তার আগেই পুকাই ফস করে বলে বসল,

“নিশ্চয়ই যাব দাদু! নারাণ বলছিল, কতদিনের শখ তোমার বাড়িতে যাওয়ার।”

“ব্যাস, চলে আয় তবে।” রহস্যময় হেসে এগিয়ে গেল গবুদাদু।

ওমনি আমি চোখ পাকিয়ে পুকাইকে বললাম

,

“এটা কী হলো? আমার নাম করে বলার কি কোনো দরকার ছিল?”

“আহা, গবুদাদু তো তোকেই ডাকলেন, তাই তোর নামে বললে যে উনি খুশি হবেন, সেটা বুঝিস না?”

“ঢের বুঝেছি, এরপর রবিবার এলে তোরা কেটে পড়বি, ঠিক জানি।” নিশ্চিত কণ্ঠে বললাম আমি।

“সে হচ্ছে কেন? আমাদের বুঝি দেখবার ইচ্ছে নেই?” ভজা বলল।

“তাহলে আগ বাড়িয়ে নিজেদের নাম বললেই পারতিস?” বলে হনহন করে পা চালিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথ ধরলাম আমি।

ঢিপঢিপ বুকে রবিবারের অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু রবিবার আসার আগেই খবর রাষ্ট্র হলো, গবুদাদু নিখোঁজ হয়েছে।

আমরা কিন্তু পিছু-পা হলাম না। কথা দিয়েছি বলে কথা। দেখাই যাক না গবুদাদুর বাড়িতে গিয়ে, ব্যাপারটা কী? রবিবারের সকালে আমরা চার বন্ধু গিয়ে হাজির হলাম সেখানে। ইতিমধ্যে ছয়দিন পেরিয়ে গেছে, এখনো গবুদাদুর হদিস পাওয়া যায়নি। কিন্তু যেরকম শোরগোল হবে বলে ভেবেছিলাম, গবুদাদুর বাড়ির আশেপাশে গিয়ে সেরকম কিছুই নজরে পড়ল না। দিব্যি একটা নির্ঝঞ্ঝাট, নরম সকাল এসেছে জাঁকিয়ে বসেছে ভগ্নপ্রায় বাড়ির আনাচে-কানাচে। কাছ থেকে দেখে মনে হলো, বাড়ির চারপাশটা আগে যতটা অপরিচ্ছন্ন জংলা জায়গা মনে হতো, আসলে কিন্তু ততটাও নয়। কিছু আগাছা যেন সরে গিয়ে অনেকখানি রোদ্দুর আসার উপায় করে দিয়েছে। গবুদাদু কি তাহলে বাড়িতেই রয়েছে? স্কুলে কি তাহলে ন্যাপা আমাদের ভুল খবর দিল?

টপ করে বেড়া টপকে খগেন ঢুকে পড়লো বাড়ির বাগানে, দেখাদেখি আমরাও। সামনের দরজায় গিয়ে বিস্তর ডাকাডাকি করেও যখন কারুর সাড়া পাওয়া গেল না, তখন আমরা নিশ্চিত হলাম যে ন্যাপার কথাই ঠিক। কিন্তু এতদূর যখন সাহস করে এসেছি, তখন একবার ভিতরে ঢুকবো না? কত কানাঘুষো শুনি শালবনের এইদিকটা নিয়ে, ধারেকাছে নাকি ভূত-প্রেতেদের বাস, অদ্ভুতুড়ে সব কাণ্ডকারখানা হয়, তা অত বড় সুয্যিমামা আকাশে থাকতে আমরা কি একবার যাচাই করবো না সে কথা? বাড়ির ভিতরে একবার ঢুকে দেখলে ক্ষতি কী?

এই ভেবে আমরা চার বীর মনস্থির করলাম, বাড়িটা ঘুরে দেখা যাক। সদর দরজা দিয়ে ঢুকে সামনে পড়ল এক বিরাট হলঘর। আমাদের আস্ত ফুটবল মাঠ এখানে ছোট পড়বে। মার্বেলের মেঝেতে জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরেছে। খুব যে ধুলোয় ভরা চারপাশ, সেটা কিন্তু বলা চলে না। বরং বাইরের তুলনায় ভেতরটা দেখলে অনুমান করা যায় যে এখানে লোকজনের বসবাস আছে। হলঘর পেরিয়ে সামনে একটা লম্বা বারান্দা। সেদিকে এগোতে গিয়ে ভজা বিকট চিৎকার করে উঠলো।

“কী হলো রে ভজা?” আমরা শশব্যাস্ত হয়ে এগিয়ে গেলাম। কাঁপা আঙ্গুল তুলে ভজা দেখাল বারান্দার অন্য প্রান্তে। মুখ দিয়ে ওর কথা সরছে না। দেখে আমরাও আঁতকে উঠলাম। ওপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে ছাদ সমান উঁচু গবুদাদু! আলো আঁধারিতে কী অদ্ভুত দানবিক রূপ তার। কিন্তু এ কী, গবুদাদুর বৃহদাকৃতি মাথার উপর থেকে একটা পায়রা উড়ে গেল যে, তবুও তাঁর কোনো হেলদোল নেই! ডানা ঝটপট করে আরো দুটো পায়রা এসে বসলো সেখানে, তাও কোনো নড়নচড়ন নেই। এ কেমন দানব? একটু সাহস করে পুকাই এগিয়ে গেল দুই পা।

“আরে এ তো ছবি!”

ওর কথায় আমরাও এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, সত্যিই তো, ছবিই বটে। দেওয়ালজোড়া এক ছবি, একেবারে জীবন্ত মনে হচ্ছে! এবার ভালো করে লক্ষ করলাম, গবুদাদুর সাথে সাদৃশ্য থাকলেও ছবিটা দাদুর নিজের নয়। মনে হচ্ছে দাদুর কোনো পূর্বপুরুষের। এ হেন বিরাট ছবি মূল গৃহে ঢোকার মুখে টাঙিয়ে রাখার উদ্দেশ্য কী, বুঝলাম না। বোধহয় দাদুর পূর্বপুরুষ বোঝাতে চাইছেন, এ বাড়িতে সর্বদা অদেখা অন্তর্যামীর চোখ রয়েছে! হুটহাট যেখানে সেখানে যেতে হলে ইন্দ্রীয় সজাগ রাখতে হবে।

“ওই দেখ, উপরে ওঠার সিঁড়ি।” আমি সোৎসাহে বললাম, “যাবি দোতলায়? গবেষণাগার দেখতে হবে তো?”

অন্যরা দেখলাম সায় দিল না। ছবি কান্ডের পর আর কী কী চমক অপেক্ষা করছে, সেটা জানার আগ্রহ কারুর নেই। কেউ রাজি হচ্ছে না দেখে আমি একাই যাব ঠিক করলাম।

ঘর অনুপাতে সিঁড়ি খুবই সরু, একজন একজন করে উঠতে হয়। আলো বড় কম এখানে। কিন্তু উঠেই আক্কেল গুড়ুম অবস্থা। দোতলার অনেকটা অংশ ধসে পড়েছে। তবে সিঁড়ির একেবারে সামনে একটা ঘর আছে। একটু সাবধানে পা বাড়ালে অনায়াসে ঢোকা যাবে সেখানে। কিন্তু যেই না আমি সেখানে ঢুকলাম, একেবারে ভেবলে গেলাম।

ঘরটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। একটা আসবাব পর্যন্ত নেই। জানলাবিহীন স্যাঁতস্যাঁতে এই ঘরের একদম শেষপ্রান্তে শুধুমাত্র একটা পেল্লায় বড় কাঠের আলমারি। তার মস্ত দুই পাল্লায় খোদাই করা একটা আজব জীব। না সে গাছ, না সে মানুষ। দুইয়ের সংমিশ্রণে কিম্ভুত কিমাকার গাছ-মানুষ। ঠিক কেমনটা যদি উদাহরণ দিতে হয়, বলতে হবে উপরের অংশটা মানুষের মুখ, ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া উড়ন্ত চুল উপরের দিকে উড়ে ক্রমে লতা-পাতায় পরিণত হয়েছে, দুই দিকে দুই মোটা ডাল বেরিয়ে এসে প্রসারিত হয়েছে হাতের আঙ্গুলে, আঙ্গুল থেকে পাতার গুচ্ছে। তার সমস্ত শরীর একটা মোটা গাছের কাণ্ড। নিচের দিকে, যেখানে দুটো পা থাকার কথা, তার তলা থেকে ক্রমে শিকড়ে নেমে এসে মিশেছে মাটির ভিতরে। মাটিই বটে, কারণ এই অদ্ভুত জিনিসের চারপাশে অজস্র গুল্ম খোদাই করা রয়েছে, তারও কিছু নীচে খোদাই করা হয়েছে মস্ত গাছের শিকড়।

ভারি কৌতূহল হলো আমার। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম আলমারির সামনে। নিখুঁত কারুকার্য করা আলমারির গায়ে রয়েছে একটা ব্রোঞ্জের হাতল। হাতল ধরে ঘোরাতে, এক ঝটকায় খুলে গেল আলমারির পাল্লা। লম্বায় আর প্রস্থে যত বড়, দৈর্ঘ্য কিন্তু মোটেই ততটা নয়। ফাঁকা আলমারিতে না কোনো তাক রয়েছে আর না একটাও জিনিস। কিন্তু কান পাতলে ও কিসের শব্দ শোনা যায়? দুই কান হাত দিয়ে ঢাকলে যেমন নিজের অন্তর থেকে গভীর এক সমুদ্রের উথাল-পাথাল আওয়াজ ভেসে উঠে আসে, তেমনই মনে হলো এই আলমারির গভীর থেকে কোনও আওয়াজ আসছে। কিন্তু আলমারি তো ওইটুকুই। এরকম আওয়াজের উৎস তবে কী হতে পারে? নাহ, উৎসাহ থাকলেও এই রহস্যের সমাধান কীভাবে করবো ভেবে স্থির করতে পারলাম না। কৌতূহলবশত এই ঘরে ঢুকে অনেকক্ষন সময় একলা কাটিয়েছি, এবার বেরিয়ে যাওয়াই শ্রেয়। অতএব, আলমারির পাল্লা বন্ধ করে দরজার দিকে পা বাড়ালাম।

কিন্তু পরক্ষনেই স্থির হয়ে গেলাম। ভারি বুটের আওয়াজ বারান্দায়, কেউ এগিয়ে আসছে এই ঘরের দিকে, একেবারে দরজার বাইরে এসে থেমে গেল তার জুতোর মচমচ শব্দ। বেশ বুঝলাম, সে যেই হোক, আমার বন্ধুদের মধ্যে কেউ নয়। কারণ আমরা সবাই ফটফট শব্দ তোলা হাওয়াই চটি পরে এসেছি। এই আগন্তুক তাহলে কে?

দরজার হাতল ততক্ষনে ঘুরতে শুরু করেছে। এভাবে নিরাপত্তাহীন দাঁড়িয়ে থাকা বড্ড বোকামি। পালানোর পথ একটাই, সেটা বন্ধ। কোথায় লুকাবো আমি? এদিক-সেদিক তাকিয়ে শেষ মুহূর্তে আলমারির পাল্লা খুলে তার ভিতরে ঢুকে পাল্লা বন্ধ করলাম।

বদ্ধ জায়গায় আমার বরাবরই হাঁসফাঁস লাগে, তাই বাধ্য হয়ে যখন আলমারিতে ঢুকেছিলাম, তখনই দুচোখ বন্ধ করে নিয়েছিলাম। কিন্তু আওয়াজটা এবারে মনে হলো আলমারির একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালো। অগত্যা যতটা সম্ভব পিছিয়ে এক কোণে সরে এলাম। তবুও আগন্তুক যদি পাল্লা খোলে, সামনেই পড়বো আমি। একটা ঠান্ডা ধাতব স্পর্শ অনুভব করলাম হাতের কনুইয়ে। পাশ ফিরে দেখি আলমারির ভিতরটা সম্পূর্ণ কাঠের নয়। যেখানে ভেবেছিলাম আলমারি শেষ হয়েছে, সেখানে আদৌ হয়নি তার শেষ। একটা লোহার সিঁড়ি নেমে গেছে অতল গহ্বরে! ওদিকে ক্যাঁচ করে আলমারির হাতল ঘুরছে, দরদর করে ঘামছি আমি। পাল্লাটা সবে ফাঁক হতে শুরু করেছে। উপায় না পেয়ে আমি তাড়াহুড়ো করে লোহার সিঁড়ি ধরে নীচে নামতে শুরু করলাম।

নামতে নামতে পাল্লা খোলার আওয়াজ পেলাম ঠিকই, কিন্তু বন্ধ হওয়ার শব্দ এলো না। যাক গে, এই পুরোনো বাড়িতে এক সাংঘাতিক আবিষ্কার করেছি, একটা গুপ্ত সুড়ঙ্গপথ খুঁজে পেয়েছি, সে কি কম বড় ব্যাপার? ফিরে গিয়ে সব্বাইকে বলতে হবে। তাই নেমেই যখন পড়েছি, যা থাকে কপালে, এই ভেবে এক-বুক সাহস নিয়ে নামতে থাকলাম আরও। দেখাই যাক না, এর শেষ হয় কোথায়? কী আছে সেখানে?

কিছুক্ষন নামার পর পায়ের তলায় মাটি ঠেকলো। সামনে নরম সবুজ আলো দেখা যাচ্ছে। তাড়াহুড়োয় এতক্ষণ খেয়াল করিনি, হুট করেই আওয়াজটা কানে এলো - সমুদ্রের ঢেউয়ের উথাল-পাথাল আওয়াজ। সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে কিন্তু কিছুই নেই, শুধু মাটির একফালি সরু পথ এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। কোনরকমে হামাগুড়ি দিয়ে এগোনো যায়। এবারে সাহসটা একটু কমে গেল আমার। না জানি কী আছে ওইদিকে। তরতর করে একটা আলমারির ভিতর দিয়ে এতটা আসা কি ঠিক হয়েছে? উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি অন্ধকার, কিছুই বোঝা যায় না। ঢোক গিলে সামনের দিকে ঝুঁকে হামা দিই বরং।

মাটি হাতড়ে সামনের দিকে কিছুদূর এগোনোর পর নজরে এলো, পথ শেষ হয়ে মিশেছে একটা বিশাল বড় ঘরে। অবশ্য ঘর নয় যেন, এক আস্ত বাগান। কত গাছপালা সেখানে, ছোট-বড়-মাঝারি। কারুর নাম জানা নেই, সবই কেমন অচেনা উদ্ভট আকৃতির। ঘরের ছাদ যে কত উঁচুতে বোঝা দায়। সেখান থেকেই আসছে সবুজ আলো। গাছের পাতা নড়ছে যেমন ঝোড়ো হাওয়া দিলে নড়ে, অথচ কোনো হাওয়া নেই কোথাও। শোঁ-শোঁ শব্দে গভীর মাটির অন্তস্থল থেকে ওরা জল টানছে, তারই আওয়াজে মনে হচ্ছে। ঘরের মধ্যে এতগুলো গাছের সমাগমে এসে পড়ায়, মনে হলো ওদের সব ক্রিয়াকলাপ বন্ধ হয়ে গেল। গাছেরা কি শুনতে পেল, বুঝতে পারল আমার উপস্থিতি? সামনে এগিয়ে গিয়ে একটা গাছ একটু ভালো করে দেখতে গিয়ে দেখি, তার ডালপালা কেমন খসখসে। হাত দিয়ে দেখতে গিয়ে চমকে উঠলাম। গাছটা একটা আর্তনাদ করে পিছিয়ে গেল দুই পা আর গলা ছেড়ে চিৎকার করে উঠলাম আমি!

ঘাবড়ে গিয়ে এক লাফে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে যাবো, কিন্তু এ কী কান্ড... ইতিমধ্যে গাছেরা আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে! এরা গুঁড়ি ঘষে এগোতে পারে, বুঝি মাটির তলে জলের মধ্যে ভেসে এগোচ্ছে! মাটির তলা থেকেই ক্ষীণ জলচ্ছাসের আওয়াজ আসছে, এতক্ষন এই আওয়াজই সমুদ্রের গর্জন বলে আমার ভ্রম হয়েছিল। ভালো করে তাকিয়ে দেখি গাছেদের ডালপালা সব শেষ হয়েছে আঙ্গুলে, উপরের দিকে ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া পাতা-গুচ্ছের তলায় খানিক মানুষের মুখের আকৃতি। আর, ও কী? ওই তো দুটো চোখ! এরা তো সেই বস্তু যা আলমারির গায়ে খোদাই করা আছে - গাছ-মানব! এসব কিম্ভুত উদ্ভিদ যে বাস্তব হতে পারে, সে আমার কল্পনার বাইরে। আমার পা মাটিতে সেঁটে যাওয়ার জোগাড়, হাত-পা ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে। কোথায় যে এসে পড়লাম, কেন যে আগ বাড়িয়ে এলাম... বেজায় ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম,

“গবুদাদু তুমি কোথায়? বাঁচাও গবুদাদু, বাঁচাও...”

তক্ষনি একটা চমৎকার ঘটে গেল!

আমার পিছনদিক থেকে একজন এগিয়ে এসে আমার মাথায় টোকা দিয়ে পরিষ্কার মানুষের ভাষায় গলা খাঁকরে বলল,

“এত ভয় পেয়ে যাও কেন হে নারাণ? দেখতে পাচ্ছ না এখানে দরকারি কাজ হচ্ছে?”

“গবুদাদু, তুমি?” বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলাম গবুদাদু আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখের তলায় কালি পড়েছে, রুক্ষ চেহারা।

“তোমার এ কী দুরবস্থা? কেমন করে এমনটা হলো? দাঁড়াও আমি এখনই ডাক্তার ডেকে আনি!” সব ভুলে আমি অনর্গল বকে চললাম।

“আরে দাঁড়াও, যাবে কোথা?” পথ রোধ করে দাঁড়ালো আরেকটা গাছ, মানে ওই গাছ-মানুষ। এরা কথাও বলতে পারে? আমি হতবাক হয়ে গবুদাদুর দিকে তাকালাম। হচ্ছেটা কী?

আমার মনের কথা বুঝতে পেরে গবুদাদু আমার কাঁধে আলতো করে হাত রেখে আমাকে এই ঘরের আড়ালে থাকা অন্য একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো। এই ঘরে একটা বিরাট কাঠের টেবিল, কতগুলো পুরনো কাঠের আলমারি, চারদিকে অনেক যন্ত্রপাতি, বিকারে রাসায়নিক পদার্থ আর ছাদে একটা ছোট্ট বাল্ব থেকে উৎপন্ন হওয়া টিমটিমে হলদে আলো। এটা নাকি গবুদাদুর গুপ্ত অফিসঘর!

“নারাণ, এই সমস্ত হচ্ছে আমার গুপ্ত গবেষণাগার। বাইরে যাদের দেখলে, এরা কারা জানো?”

আশ্চর্য হওয়ার আর বাকি ছিল না আমার। মুখটা হাঁ রেখেই নেতিবাচক ঘাড় নাড়লাম।

“আমার বিগত বিয়াল্লিশ বছরের কর্মের ফসল এই উদ্যান।” আমি আন্দাজ করলাম গবুদাদু ওই গাছেদের কথা বলছে।

“অনেক অধ্যাবসায়, অনেক পরিশ্রম করে আমি সংগ্রহ করেছি গাছের স্টেম সেল - মেরিস্টেম। তার সাথে সংগ্রহ করেছি মানুষের শরীরের ভিন্ন জায়গায় থাকা স্টেম সেল, যেমন মাথায়, অস্থি মজ্জায়, রক্তনালীতে, পেশীতে, ত্বকে, হার্টে। এসবের সংমিশ্রণে তৈরি করেছি এস.ভি.এফ., মানে ‘স্টেম সেল কালচার’। সেইটা আশানুরূপ তৈরি করতে আমার জীবদ্দশা প্রায় শেষ হতে চলল।”

“তারপর তারপর?” সব ভুলে আমি অধীর আগ্রহে জিজ্ঞাসা করলাম।

“তারপর সেই কালচারের ওপর আরো অনেক জটিল প্রক্রিয়া এনে তৈরি করলাম এক বিশেষ ধরনের সেরাম। সেইটা আমি বিশেষ কিছু মানুষের উপর প্রয়োগ করা শুরু করলাম। দীর্ঘ বিশ বছর লেগেছে আজকের এই ফল পেতে। এই উদ্যানের সমস্ত গাছগাছালি আমার অক্লান্ত পরিশ্রমের পরিণাম।”

“মানুষের উপর প্রয়োগ করলে একেবারে? তার আগে অন্য কোনভাবে পরীক্ষা করলে না দাদু?” আমি শিউরে উঠে বললাম।

“ভয় পেয়ো না নারাণ। আমি তাদের উপরেই পরীক্ষা চালিয়েছি, যারা সদিচ্ছায় এসেছে আমার কাছে। এমন অনেক মানুষ আছে নারাণ, যারা জীবনের লক্ষ্য হারিয়ে ফেলে। হাজারো কারণে পলাতক, বেকার, ভবঘুরে, এমন আরো অনেক রকমের মানুষ যারা জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পাচ্ছিল না। আমি তাদের খুঁজে খুঁজে বের করেছি। দিনের পর দিন সময় নিয়ে যত্ন করে বুঝিয়েছি আমার কাজ, আমার স্বপ্ন। জিজ্ঞাসা করেছি আমার এই গবেষণায় তারা যোগদান করতে রাজি কি না। প্রত্যেকের সম্মতি নিয়ে তারপরেই আমি তার উপর আমার তৈরি সেরাম প্রয়োগ করেছি।”

“এদের কী হয়েছে দাদু?”

“এরা মানুষ, কিন্তু এদের মধ্যে গাছের বৈশিষ্ট্যও এসেছে। এদের আমি মানবদ্ভিদ বলি। মানুষ যুক্ত উদ্ভিদ। দৃশ্যত এরা অর্ধেক গাছ, অর্ধেক মানুষ। মানুষের চামড়ার উপরের এক স্তর গাছের ছাল তৈরি হয়েছে দেখ। সেই কারণেই এদের শরীর দেখলে মনে হবে কোনো গাছ। মাথার চুল তো মৃত কোষ, কিন্তু তার ভিতরে থাকা শিকড় তো জীবন্ত, এটা নিশ্চয়ই পড়েছ নারাণ? সেই শিকড় থেকে উদ্ভিদের মতো পাতা জাতীয় ওই জিনিসগুলো বেড়ে উঠেছে বাইরের দিকে। তারা আলো শুষে নিতে পারে জানো? দুই হাতের আঙ্গুলের শেষ থেকেও পাতাগুচ্ছের উৎপত্তি হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে গাছের ডালপালার শেষে আঙ্গুল গজিয়েছে দেখতে লাগলেও, আসলে কিন্তু হাতের উপরে তৈরি হয়েছে ফ্লোয়েম - গাছের জীবন্ত ছাল যার মাধ্যমে গাছের মাথা থেকে গুঁড়ি অবধি খাদ্য সঞ্চালন হয়। তেমনই পায়ের পাতার চারপাশ দিয়ে তৈরি হয়েছে শিকড়। এগুলো প্রধানত মাটি ভেদ করে স্থায়ীত্ব খোঁজে। জল শুষে নিতে পারে মাটির তলা থেকে, যার কারণে একটি তরঙ্গের আছড়ে পড়ার আওয়াজ পাচ্ছ। কিন্তু প্রয়োজন মতো ওরা নিজেদের শিকড় গুটিয়ে নিতে পারে মূল গুঁড়ির কাছে। তখন ওরা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে। খাদ্যের অভাবে, আলো-বাতাস-জল কাজে লাগিয়ে এই মানবদ্ভিদ বেঁচে থাকতে পারে। এদের সৃষ্টি একটা বিপ্লব নারাণ, বিপ্লব!”

“কিন্তু কিসের বিপ্লব? কী কারণে এদের সৃষ্টি?” জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

“কেন, স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য কি যথেষ্ট নয়? তাছাড়া, এরা সমাজের কত মঙ্গল করতে পারে ভেবে দেখ নারাণ। নীরব নিরাপত্তারক্ষী হয়ে কত মানুষের সাহায্য করতে পারে গাছের ছদ্মবেশে। ভাবো, রাস্তাঘাটে অথবা স্কুলে, কলেজে, হাসপাতালে, অফিসে, বাজারে… যে কোন কোথাও কোনরকম গন্ডগোল বাধল, তখন এরা কেউ সেই ঘটনাস্থলে সাক্ষী হয়ে রইলো। দরকার হলে উপযুক্ত জায়গায় খবর পাঠিয়ে পরিত্রানের ব্যাবস্থা করতে পারবে। আসল অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রমাণ দিতে পারবে। ভাবো নারাণ, রাত-বিরেতে অন্ধকারের আশ্রয়ে ভয় দেখিয়েও কিন্তু এরা দুষ্কৃতিকে আটকাতে পারে!” মুচকি হাসল গবুদাদু।

“বেশ মজার ব্যাপার তো! কিন্তু তুমি কেন লোকচক্ষুর বাইরে এইরকম মস্ত কাজ করছ? মাটির তলায় কেন এই ব্যবস্থা, যখন মাটির উপরে এসব সহজভাবে করা সম্ভব? এদিকে সমস্ত গ্রাম জানে যে তুমি নিখোঁজ হয়েছ!” আমি বেশ অবাক হলাম।

“আমি আসলে স্বেচ্ছায় নিরুদ্দেশ হয়ে এসেছি এখানে। আমার গবেষণার কথা জানতে পেরে কয়েকজন বিশিষ্ট বানিজ্যিকের কাছ থেকে আমার ডাক এসেছে।” মস্ত গোলগোল চোখে তাকায় গবুদাদু।

“সে যে কী ভীষন ডাক আর কী তার পরিণতি, সে আমি বেশ জানি। তাই তো আপাতত গা ঢাকা দিয়ে রয়েছি এখানে, যতদিন না হাওয়া শান্ত হচ্ছে। এই যে গবেষণাগার দেখছ, এ আমার কাজের সামান্য নমুনা মাত্র। বিশেষ প্রয়োজনে যাতে আমি লোকচক্ষুর আড়ালেও কাজ চালিয়ে যেতে পারি, এই মানবদ্ভিদ জাতিকে যাতে আরও নির্ভুল তৈরি করতে পারি, সেই কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাতেই এই গুপ্ত গবেষণাগার একসময়ে তৈরি করেছিলাম। আমার কিছু নমুনা এরা, যাদের তুমি দেখছ। এরা স্বাধীনভাবে আগে আমার বাগানে বিচরণ করতো। তাই তো এমন ভেঙেচুরে পড়ছে বাড়িটা একদিকে। অগোছালো বাড়ি রেখেছিলাম সেই কারণেই তো, যাতে কারুর চোখে না পড়ে আমার গবেষণার কাজ। এতে ঝুঁকি অনেক। কিন্তু দেখ, সেই ফাঁপরে পড়তে হলো। কীভাবে খবর পৌঁছে গেল অনভিপ্রেত কিছু মানুষের কাছে। আমাকে রাতারাতি তল্পিতল্পা গুটিয়ে এখানে চলে আসতে হলো।”

“কিন্তু কিসের জন্য ডেকেছে ওরা? কেনই বা তুমি লুকোতে চাইছ? তুমি কি কোনো অন্যায় করেছ?” আমি জানতে চাইলাম।

গবুদাদু আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে এবার বলল, “নারাণ, তুমি খুব ছোট। তাই হয়তো ভাবতেও পারছ না যে আমার এই সৃষ্টি সমাজের জন্য যতটা মঙ্গলের, ততটা অমঙ্গলেরও। এদের অন্যায়ভাবে ব্যাবহার করলে এরা তো খারাপ লোকের হয়েও কাজ করতে পারে, তাই না? এই কাজ অত্যন্ত গোপন স্তরে করছিলাম শুধু এদের নিজেদের ভালোর জন্য, দ্বিতীয় ব্যক্তি অথবা স্বার্থলাভের কারণে নয়। জনসমক্ষে চলে এলে অনেকের বিস্তর ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। আমি আন্দাজ করছি এদের যুদ্ধে ব্যবহার করার কাজে চাওয়া হচ্ছে। এরা লুকিয়ে যাতে খবরাখবর নিতে পারে সীমান্তে, শত্রুদের গোপন খবরাখবর এনে দিতে পারে, দরকারে চূড়ান্ত ধ্বংস করতে পারে শত্রুবাহিনীর শিবিরে পৌঁছে, সেইসব বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করার পরিকল্পনা চলছে। ওরা চাইছে আমার গবেষণার সমস্ত কাজ আর স্বত্ত কিনে নিতে। আমাকে দ্রুত কাজ সেরে চূড়ান্ত সেরাম তৈরি করতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমি তো সেটা চাইনি। আমি তো যুদ্ধের অস্ত্র তৈরি করার কারিগর না। আমি বৈজ্ঞানিক, আমি মানুষ বাঁচাতে, সুস্থ পৃথিবী তৈরি করতে ব্রতী। কেন আমি ওদের অস্ত্র হিসেবে তুলে দেব বলতে পারো? ওরা যখন নিজেদের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে নিতে রাজি হয়েছে, তখন আমি কেন ওদের এই নিষ্ঠা, এই ত্যাগ, এই উৎসর্গ কোনো খারাপ কাজে লাগাবো? সেই জন্যই দেশের চারদিকে বার্তা গেছে যে আমি নিখোঁজ। আমার জীবনব্যাপী কাজ আজ অর্ধসমাপ্ত আর সম্পূর্ন অকৃতকার্য।”

খুব বিষন্ন দেখায় গবুদাদুকে।

“কিন্তু তোমার কাজ তো এগোচ্ছে গবুদাদু?” আমি জিজ্ঞাসা না করে পারি না। “এরাই বা কতদিন এখানে থাকবে এই অবস্থায়? একদিন না একদিন তো বেরোতেই হবে বাইরে, মাটির উপরে। তখন তো এদের দেখলে সাধারণ মানুষ চিনে যাবে?”

“না, নিয়মিত সেরাম না দিতে থাকলে, এরা গাছের বৈশিষ্ট্য হারাবে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে। হয়তো অনেক সময় লাগবে, হয়তো সম্পূর্ন পরিত্যাগ করতে পারবে না সমস্ত মানবদ্ভিদগত আচরণ। কিন্তু এই অবস্থা ধরেও রাখতে পারবে না, উন্নতিও হবে না। তখন ওরা আগের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু ওরা কেউই আর সেই জীবনে ফিরে যেতে চায় না। প্রত্যেকে বলে, এইই ভালো। তাই, যতক্ষণ না নিরাপদ জায়গা খুঁজে সেখানে ওদের নিয়ে যেতে পারছি, ততক্ষন এইটাই ওদের আশ্রয়।”

“এটা কি খুব নিরাপদ জায়গা গবুদাদু? আমি কিন্তু ভুল করে হলেও, আলমারি খুলে এখানে পৌঁছে গেলাম। বড়ো কেউ তো সেটা আরো সহজে পারবে?”

রহস্যময় হেসে গবুদাদু বলল

,

“ওই আলমারি আমার আরেক সৃষ্টি। যান্ত্রিক-গাছ। ওটা আসলে কৃত্রিম গাছ। দরকার মতো কিছু বিশেষ আকার ধারণ করতে পারে। তাছাড়া চলাফেরা করার ক্ষমতা আছে ওর মধ্যে। তোমাকে আর তোমার পরে আমাকে এই সুড়ঙ্গে ঢুকিয়ে দিয়ে, আমার নির্দেশ মতো সে এই পথ বন্ধ করে দিয়েছে। লোহার সিঁড়ি দিয়ে দু-চার ফুট নীচে নামলেও কেউ কোনও রাস্তা পাবে না। একাধারে তৈরি করেছি গাছ-মানুষ, অন্যধারে যান্ত্রিক-গাছ। এরা একে অপরকে রক্ষা করে।”

কিংকর্তব্যবিমূ়ড় হয়ে গেলাম। বললাম, “চমৎকার!”

পরক্ষনেই মাথা চুলকে ভাবলাম, “আমি তো আলমারির পাল্লা খুলে ঢুকলাম, এতটা পথ আসলাম। এবার আমি ফেরত যাব কীভাবে?”

আমার মনের কথা বুঝতে পেরে গবুদাদু হেসে বলল,

“বাইরে বেরোনোর পথ আমি দেখিয়ে দিচ্ছি, যদি তুমি কথা দাও নারাণ, যে আমার আর আমার গুপ্ত গবেষণাগার দেখার কথা তুমি নিজের কাছেই রাখবে। একদিন যখন তুমি বড় হবে, যদি সুযোগ পাও, এগিয়ে নিয়ে যেও এই কাজ। তা নাহলে এখানেই চাপা পড়ে থাক সমস্ত প্রমাণ। আর কোনোদিন যদি আমার কোনো মানবদ্ভিদকে দেখতে পেয়ে যাও সুদূর কোথাও, বুঝবে আমি আছি কাছাকাছি, অথবা এদের আশেপাশে আছে কোনো যোগ্য মানুষ। কারণ আমি এতবছর পর বুঝেছি, হিংস্র পৃথিবীতে এদের সৃষ্টি করা বড়ো দায়।”

গবুদাদু আমাকে বাইরে যাওয়ার অন্য একটা পথ দেখিয়ে দিল। সেই সরু অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ ধরে অনেক অনেক দূর এগিয়ে পেলাম বেরোনোর সিঁড়ি। কিন্তু এবারের সিঁড়ি লোহার নয়, মাটি দিয়েই ধাপে ধাপে উঠে গেছে উপরে। যখন ভূমির উপরে পা রাখলাম, দেখলাম সূর্য প্রায় মধ্যগগনে উঠেছে, ঝিলমিল করছে বিদ্যাধরীর জল।

গবুদাদুর বাগানে ফিরে গিয়ে দেখি, পুকাইরা তখনও বসে আছে বাগানে। আমাকে দেখে খগেন বলল,

“তোর আক্কেল কী হে? তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম আর তুই কেটে পড়লি? দোতলা থেকে নামলি কখন? কোথায় গিয়েছিলি?”

“নেমেছিলাম একসময়ে। চল ফিরি, অনেক বেলা হয়েছে। ধীরেন মাষ্টার এখানে আমাদের দেখলে আর রক্ষে নেই।” এই বলে ওদের নিরস্ত করে আমি হাঁটা লাগালাম।

এর কয়েকদিন পর আবার একা একদিন গিয়েছিলাম গবুদাদুর বাড়িতে। কিন্তু সেই ঘরে গিয়ে দেখলাম কোনো আলমারি নেই। শেওলা ধরা দেওয়াল যেন এগিয়ে এসেছে। বিদ্যাধরীর তীরে ওই খোলা জায়গাটাও বন্ধ। মনটা ভার হয়ে গেল। বাড়ির পিছনদিকে বনে-জঙ্গলে ভরা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে একটা বিরাট পাতা চোখে পড়লো, যেটা স্বাভাবিক কোনো গাছের পাতা নয়। উল্টেপাল্টে খুব মনযোগ দিয়ে দেখতে, চোখে পড়লো পাতার শিরা-উপশিরা মিলে বুঝি লেখা – “আবার আসিব ফিরিয়া!”

কী জানি, সত্যিই লেখা না কি আমার মনের ভ্রম? তবে এটা দেখামাত্র আমার মন অনেকটা হাল্কা হয়ে গেল। বুঝলাম, গবুদাদু তার অনন্যসাধারণ সৃষ্টির মধ্যে ভালো আছে।

সমাপ্ত।।