সূচিতে ফিরুন

কেল্লা প্রাসাদের অশরীরী

লেখক - দীপঙ্কর বসু

সেদিন পরাণ দার দোকানের আমাদের রবিবারের আড্ডায় ভূত নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আড্ডার সকলেই মানে গোবিন্দ বাবু, অমল বাবু, অপূর্ব বাবু, সমীরণ,ডরোথি এবং পরাণ দা সবাই অংশগ্রহণ করেছিলেন এই আলোচনায়। শুধু নকা মামা ছাড়া। মামা উদাসীন মুখ নিয়ে চা পান করছিলেন।  চায়ের কাপ শেষ হলে বললেন, “ সামনের অমাবস্যার দিন সকলে চলে আসুন আমার বাড়িতে। শোনাব সত্যি ভূতের সত্য ঘটনা। এমন সুযোগ কি আর সবসময় মেলে! হৈ হৈ করে সকলে সম্মতি দিয়ে দিল। img

সেদিন মামার বাড়িতে যখন সকলে হাজির হলাম তখন আকাশে চাঁদের আলো না থাকায় মিশমিশে কালো আকাশে জোনাকির আলোর মত মিটিমিটি জ্বলছে অসংখ্য তারা। নকামামার বাড়িটা একটু নির্জন জায়গায় হওয়ার জন্য আলোর অভাবে চারিদিকটা বেশ থমথমে। মামী বাড়িতে না থাকায়  মামাও  পরিবেশ এমন তৈরি করেছিলেন যে সকলেই বেশ রোমাঞ্চ বোধ করছিলাম। ঘরের কোণে জিরো পাওয়ারের একটি টিমটিমে আলো ছাড়া ঘরে আর কোন আলোর লেশ মাত্র নেই। মাঝখানে নানা ছবি আঁকা একটি প্ল্যাস্টিকের মাদুর। টিমটিমে আলোর আলো আঁধারি পরিবেশে ছবিগুলো দেখে বিভিন্ন ভৌতিক সিনেমায় দেখা অশরীরীদের কথা মনে পড়ছিল। নকামামাকে মাঝখানে রেখে আমরা সকলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়লাম সেই ভৌতিক মাদুরে। পরিবেশে কেমন একটা অশুভ ইঙ্গিত। খানিকক্ষণ চুপ থেকে মামা শুরু করলেন তাঁর কাহিনী।

 বছর পাঁচেক আগের কথা। ছোট বেলার বন্ধু দিল্লীনিবাসী পেশায় ডাক্তার, অনির্বাণের পীড়াপীড়িতে দিল্লী গিয়েছিলাম বই মেলার উদ্বোধনে। মেলা সাঙ্গ হওয়ার পরে অনির্বাণ বলায় রাজি হয়ে গেলাম নতুন দিল্লী থেকে ১২২ কিমি দূরের এক কেল্লা-প্রাসাদে দুদিনের ভ্রমণে। কেল্লা- প্রাসাদটি ১৪৬৪ সালে পারমার রাজপুতদের রাজা আজমেরের চৌহান মহারাজদের সহায়তায় বানিয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন ভাঁজ করা পাহাড় আরাবল্লী পর্বতে থাকা এই কেল্লা প্রাসাদ এক আধুনিক রিসর্টে পরিণত হয়। যাওয়ার পথে গাড়িতে অনির্বাণ বলছিল রিসর্ট হওয়ার আগে পড়ে থাকা কেল্লাপ্রাসাদের কথা।

রিসর্ট হওয়ার আগে পুরানো কেল্লাপ্রাসাদে যাবার রাস্তা বলতে তখন আর কিছু ছিল না। বালি আর মাটির উপর ক্ষুধার্ত জঙ্গলের শিকার তখন কেল্লাপ্রাসাদের চারিদিক। পায়ে যাবার রাস্তা পর্যন্ত বুনো আর লতানো গাছপালায় ছেয়ে গেছে। গাছপালার ফাঁক দিয়ে কেল্লাপ্রাসাদটি তখন ভূতুড়ে বাড়ির চেহারা নিয়েছে। হিংস্র আবহাওয়ার দীর্ঘ আক্রমণে ক্লান্ত কেল্লাপ্রাসাদটিও তখন অতীতের সমস্ত জেল্লা হারিয়েছে। কেল্লার আনাচে কানাচে তখন চামচিকে, পাখী আর বন্য পশুদের আস্তানা। কেল্লার ভিতরের মেঝে, পর্দা, তৈলচিত্র, ঝাড়বাতি, বাতিদান সমস্ত কিছু পুরু ধুলোতে ভর্তি। আসবাবপত্রের ভাঁজে গিরগিটিদের সংসার। স্নানের জায়গা আর মার্বেলে শ্যাওলার আস্তরণ। সকলে ধরেই নিয়েছিল অথর্ব কেল্লাপ্রাসাদটি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। ভূতেরাই রাজত্ব করছে অথর্ব প্রাসাদটিতে এমনই ধারণা জন্মে গিয়েছিল স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে।। ছড়িয়ে পড়েছিল অশরীরীদের নিয়ে অনেক গল্পও।     

রিসর্টে যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে সময় দুপুর ১ টা। আগেই বুকিং ছিল তাই ঘর পেতে সময় লাগলো না। ঘোরানো প্যাঁচানো খাড়া অনেকটা পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম পাথরে বাঁধানো খোলা এক জায়গায়। চারপাশে কারুকার্যের খিলান করা অনেক ঘর। দুপাশে দূর্গের মত দ্বিতল স্থাপত্য পেরিয়ে আসতে হয় এই খোলা জায়গায়। আমাদের ঘরটা ছিল খোলা জায়গার বাঁ দিকে।     

ঝাঁঝরির নকশা করা এক অপূর্ব সুন্দর দরজা খুলে ঢুকলাম এক অদ্ভুত ঘরে। বাঁদিকে চারটি পাথরের সিঁড়িতে উঠে যে ছোট ঘরটি দেখলাম তাতে ঘর জুড়ে আছে একটি অপরূপ পালঙ্ক যার নকশায় রাজকীয় ছাপ স্পষ্ট। একটি নকশা করা দেওয়াল আলমারি এবং কয়েকটি অনুপম অয়েল পেইন্টিং এ সমৃদ্ধ দেওয়াল। আলো প্রবেশের জায়গা না থাকায় দুপাশের দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে সুদৃশ্য দুটি আলো। সিঁড়ি দিয়ে নেমে উল্টো দিকে আরও একটি ছোট ঘর যা আসলে একটি  শৌচালয়। মাঝখানের নীচু জায়গাটার দু পাশে ঝাঁঝরির নকশা। এই ঝাঁঝরির ফোকরগুলো দিয়ে সামান্য আলো এসে জায়গাটিকে রহস্যজনক করে তুলেছে।

উদ্যান এবং প্রাসাদ মিলিয়ে রিসর্টটি ১৪ টি স্তরে ২.৫/৬ একর টিলার উপর অবস্থিত। প্রাসাদটিতে ৯টি পার্শ্বভাগ আছে। ইতিহাস সমৃদ্ধ অপূর্ব এই কেল্লা প্রাসাদ রিসর্টটিতে থাকবার জন্য আছে ৭৮টি ঘর।

ফোন করে খাবার ঘরে নিয়ে এসে মধ্যাহ্নভোজন সেরে আরামদায়ক পালঙ্কে একটা ঘুম দিয়ে যখন উঠলাম তখন সন্ধ্যার আঁধার প্রাসাদটিকে গ্রাস করেছে। পোশাক চেঞ্জ করে বেরিয়ে চাতালে পা রাখতেই অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেমন কেঁপে উঠল। ঘুরতে এসে যে এমন ভুতুড়ে পরিবেশের অভিজ্ঞতা হবে তা একেবারেই ভাবি নি। চারিদিকের ঘন অন্ধকারের মধ্যে  খিলানের নকশা করা বেরোবার পথের আর কোনের দিকে থাকা শিব মন্দিরের জোরালো সাদা আলোর আভা চাতালে পরে এমন পরিবেশের সৃষ্টি করেছে যা দেখে গা ছমছম করে।

 

 বেরোবার পথ দিয়ে বেরিয়ে কেল্লার পুরানো পাথরের কাঠামোর বেশ কয়েকটা আলো আঁধারি ঘেরা আঁকাবাঁকা ছোট বড়  সিঁড়ি আর গলি ঘুঁজি পেরিয়ে পৌঁছলাম অনেকটা উঁচুতে থাকা কৃত্রিমভাবে তৈরি এক ছোট উদ্যানের মত জায়গায়। চারপাশে পুরানো দিনের গ্যাসবাতির মত আলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাঠের কারুকার্য করা অনেকগুলি চেয়ার টেবিল। পাশে একটি বিরাট হলঘর। তাতে অনেকগুলি অপুর্ব ছোট বড় ঝাড়বাতি ঝুলছে ছাদ থেকে। দেওয়ালে বড় বড় রাজা মহারাজাদের অয়েল পেইন্টিং। সেখানেও কাঠের কারুকার্য করা অনেক চেয়ার টেবিল। একদিকে একটি অস্থায়ী মঞ্চে রাজস্থানের লোক সঙ্গীত শিল্পীরা গাইছিলেন তাঁদের গান। এখানেই ডিনারের ব্যবস্থা।

বসলাম গিয়ে বাইরের উদ্যানে। অর্ডার দিলাম কফি আর পকোড়া। টেবিলেই আলাপ হল আমাদের দুটি ঘর পরে থাকা মিলিটারি গোঁফওয়ালা সুরজিৎ সিং এবং মিসেস সিং এর সাথে। পরিচয় হল সুশীল মিশ্র এবং ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে। ডিনারের সময় আমাদের আলাপ হল কোলকাতার সেনগুপ্ত দম্পতির সঙ্গে। এর আগেও দুবার এখানে এসেছেন । বললেন, এই রহস্যেঘেরা পরিবেশ নাকি বেশ উপভোগ করেন ওঁরা। পরিচয় হল রিসর্টের ম্যানেজার মারাঠি যুবক প্রবীন দাগাদের সঙ্গে। যুবকটির চোখে মুখে কেমন যেন চিন্তার ছাপ।

খাওয়াদাওয়া হলে আবার সেই গোলকধাঁধার গলিঘুঁজি পেরিয়ে ঘরে গেলাম। সরু পথে আসতে আসতে একটু পায়ের আওয়াজ, একটু ফিসফাস, এদিক ওদিক সরে যাওয়া মানুষের ছায়া দেখে কেমন যেন একটা অস্বস্তি লাগছিল।

 

পোশাক চেঞ্জ করে শুয়ে দুই বন্ধু গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি মালুম হয় নি।

আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেল নানা কন্ঠের শোরগোল আর ফিসফিস শব্দে। অনির্বাণকে ঘুম থেকে তুলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে দেখি সুরজিৎ সিং দের ঘরের সামনে কয়েকজন ফিসফিস করে কি সব বলাবলি করছে। এগিয়ে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ঐ ঘরে নাকি ভূত দর্শন দিয়েছে। পাশে থাকা এক ভদ্রলোক বললেন, এতে আর আশর্যের কি আছে! এমন পুরানো কেল্লায় এমন ভৌতিক পরিবেশে ভূত প্রেতের উপস্থিতি না থাকাই তো অস্বাভাবিক।

র্বাণের পেশার অজুহাতে ঢুকে পড়লাম ঘরটিতে। ততক্ষণে মিসেস সিং উঠে বসেছেন। যদিও চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। অনির্বাণ পালস দেখে আর অন্যান্য প্রাথমিক পরীক্ষা করার পর মিসেস সিং কে ভয়ের কিছু নেই, এই আশ্বাস দিয়ে ওঁকে কি হয়েছিল জিজ্ঞাসা  করলেন। ঘাবড়ে যাওয়া মুখে শঙ্কিত কন্ঠে মিসেস সিং বললেন ওঁর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা। -- হঠাৎ ই জেগে গিয়েছিলাম আমি। মনে হল কেউ এসেছে আমাদের ঘরে। শুনতে পেলাম তার পায়ের শব্দ ঘরের ভিতরে এদিক ওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফিসফিস করা আওয়াজও শুনতে পেলাম। চোখের কোন দিয়ে দেখতে পেলাম ছোট সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে একটা কালো অদ্ভুত দর্শন ছায়া এগিয়ে গেল ঘরের কোনে । মনে হল কালো ছায়াটি আমাকে নিরীক্ষণ করছে। জেগে থাকলেও আমি নড়তে চড়তে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল অশুভ পৈশাচিক কিছু চেপে বসেছে আমার বুকের উপর। স্থির চোখে আমি চেষ্টা করছিলাম আমার হাত দিয়ে সুরজিৎকে ডাকতে, কিন্তু কিছুতেই আমি হাত পা নাড়াতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল স্ক্রু দিয়ে কালো ছায়া আমায় আটকে দিয়েছে। চীৎকার করে সুরজিৎকে জাগাতে চাইলেও আমার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোচ্ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ পরে মনে হল ছায়াটি আর নেই। সব কিছু স্বাভাবিক হলে ডাকলাম ওকে।

“আমি তো ওকে দেখে অবাক”, সুরজিত বলল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ভয়ার্ত মুখ। জিজ্ঞাসা করলে ও শুধু বলল অশরীরী এসেছিল। তখন আমি ঘাবড়ে গিয়ে দেরি না করে ম্যানেজার এবং পাশের ঘরের ভদ্রলোককে ডাকলাম। কি হয়েছিল তা তো ওঁর নিজের মুখেই শুনলেন। অনির্বাণ অনেক বোঝালেও মিসেস সিং ঐ ঘরে আর কিছুতেই থাকতে চাইলেন না। ম্যানেজার অন্য ঘরের ব্যবস্থা করলে আমরা সকলে যে যার ঘরে চলে গেলাম।

পরের দিন সকালে প্রাতরাশ করার জন্য যখন হলঘরে পৌঁছলাম তখন প্রায় ৯টা বাজে। রাতের খবরটা দেখলাম ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে গেছে। সিংজিরা এবং আরও বেশ কয়েকজন  শুনলাম এই ভূতের কেল্লায় আর থাকতে ইচ্ছুক নন। চলে যাবেন তারা আজকেই। ম্যানেজার মিষ্টার দাগাদেকেও দেখলাম চিন্তান্বিত মুখে সকলের দেখভাল করছিলেন। হল অনেকটা ফাঁকা হলে বললেন, “আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমার ঘরে আসলে কালকের ব্যাপারটা নিয়ে একটু আলোচনা করতে পারি।” কাজকর্ম বিশেষ না থাকায় সম্মতি দিয়ে গেলাম ওর ঘরে।

ম্যানেজার সাহেব শুরু করলেন ওর কথা। -- জানেন কালকের ঘটনায় আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গেছি। জানেন তো এই সব ভূত প্রেতের কথা দাবানলের মত দ্রুতই ছড়িয়ে পরে। এমনটা হলে ব্যবসার ক্ষতি হবে বিস্তর যার সঙ্গে আমার পেশাগত স্বার্থ জড়িয়ে আছে। কিন্তু তার থেকেও যে ব্যাপারে আমি আরও বেশী চিন্তিত তা হল, সত্যি সত্যি এই পূরানো প্রাসাদ কেল্লায় কোন অশরীরীর অস্তিত্ব আছে কি না তা নিয়ে। আমি এখানে চাকরি নিয়ে এসেছি বছর দেড়েক হল। এর মধ্যে আমার স্ত্রীরও দু বার এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে।

বললাম,“আপনার স্ত্রীর সঙ্গে একবার কথা বলা যাবে।”                                          

 ভদ্রলোকের তখন  অসহায় অবস্থা। স্ত্রীকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন হোটেলের জরুরী কাজে। ভদ্রমহিলা শোনালেন ওঁর কাহিনী। “ --অন্য দিনের মত সেদিন সন্ধ্যায় দরজার উল্টো দিকে মুখ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ও তখনও ঘরে ফেরে নি। দরজা বন্ধের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি ঘুরে দেখবার চেষ্টা করলাম যে ঘরে কে এসেছে। কিন্তু আমি নড়াচড়া করতে পারছিলাম না। ভয়ে আমার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছিল। মনে হল কিছু একটা ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরে।

 

 তারপর সেটা বিছানায় বসে পড়ল ওর ওজনে বিছানাটাও অনেকটা ডেবে গেল। ওদ্ভুত মুখের সেই বিশাল অবয়ব মনে হল আমাকে গিলে খাবার জন্য এগিয়ে আসছে। আমি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেও আমার নিথর দেহকে এতটুকু নড়াতে পাড়লাম না। অবয়বটি মনে হল আমার ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সেটি আমার হাতে পায়ে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করল। তারপর  হঠাৎ ই সেই লম্বা অবয়বটি ছায়া হয়ে খানিকক্ষণ দেওয়ালে দাপাদাপি করে মিলিয়ে গেল। ” আর কোনদিন আর এমনটা হয়েছিল কি না, আমার এই প্রশ্নের উত্তরে মিসেস দাগাদে জানালেন যে আরেকদিন রাতেও এমনই এক হাড় হিম করা ঘটনা ঘটেছিল।

উনি এতটাই আতঙ্কিত ছিলেন তারপর থেকে উনি রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারেন না। মিঃ দাগাদের এখানের চাকরি এবং ওঁদের বিবাহের মেয়াদ মাত্র কয়েক মাস হওয়ায় মিসেস দাগাদের প্রবল ইচ্ছা থাকলেও ওঁরা এখান থেকে চলে যেতে পারেন নি।

বেশ খানিকক্ষণ আলোচনার পর আমরা দুজনে উপস্থিত হলাম মিঃ দাগাদের অফিস ঘরে। বললাম অশরীরী রহস্যের সমাধানের জন্য সবাইকে মধ্যাহ্ন ভোজনের পরে ঐ হলে থাকবার  জন্য অনুরোধ করতে।

মধ্যাহ্ন ভোজনের পর হলে উপস্থিত হয়ে দেখলাম সকলেই আগেই এসে উপস্থিত হয়েছে। অনেকের মুখেই আগের রাতের ঘটনার আতঙ্ক বিদ্যমান। কেউ কেউ আবার উৎকণ্ঠিত হলেও ভূত রহস্যের পিছনের কারণ জানতে আগ্রহী। মিঃ দাগাদে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবার পর আমিই শুরু করলাম আমাদের বক্তব্য।

--- আপনারা সবাই এতক্ষণে জেনে গেছেন যে কাল রাতে মিসেস সুরজিৎ এর এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে যা আপাতদৃষ্টিতে ভৌতিক বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। ওঁর কাছে সবকিছু শোনার পর আমরা মিঃ দাগাদের কাছে এমন এক চমকেদার ঘটনার কথা শুনি যা সাধারণভাবে বুদ্ধির অগম্য। ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী হলেন মিসেস দাগাদে। গিয়েছিলাম ওঁর কথা শুনতে। একটু অন্য রকমের হলেও মিসেস দাগাদের অভিজ্ঞতাও মিসেস সিং এর মতই বেশ ভয়ঙ্কর। সব শুনে এবং আমরা দুজনে আলোচনা করে আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি যে এই ঘটনাগুলো কোন অলৌকিক ঘটনা নয়। এর সঙ্গে ভূত প্রেত কিংবা অশরীরীর কোন যোগ নেই। শুনলে অবাক হয়ে যাবেন, ভারতে প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি মানুষ এই ধরণের আপাত অলৌকিক ঘটনার  সম্মুখীন হন। শত শত বৎসর ধরে এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়া মানুষেরা এই ধরণের ঘটনাকে অশুভ বলে মনে করে এসেছেন। আরও প্রাচীন কালে এই ধরণের ঘটনাকে রাতের পিশাচ এবং দৈত্য দানবের কাজ বলে মনে করা হত। শেক্সপিয়ারের ‘রোমিও এবং জুলিয়েট’এও এমন ডাইনির উল্লেখ আছে। বর্তমানে অনেকে আবার কল্পবিজ্ঞানের এলিয়েনদের এই সব ঘটনার সাথে যুক্ত করেছেন। যুগ যুগ ধরে সমস্ত সংস্কৃতির ইতিহাসের পাতায় এমন অশুভ অশরীরীর অসহায় মানুষকে হাড় হিম করা ভয় দেখানোর অসংখ্য গল্প পাওয়া যাবে। এরই মধ্যে কিছু অনুসন্ধিৎসু মানুষ খুঁজে বেড়িয়েছেন এই রহস্যের পিছনের কারণ।

আসলে এই ভয়ঙ্কর ব্যাপারের পিছনে আছে স্লিপ প্যারালাইসিস বা ঘুমের অসারতা। ঘুম আসার সময় আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের হাত পা এবং শরীর শিথিল হতে সাহায্য করে। ঘুম থেকে জাগার সময় মস্তিষ্কই আবার শরীরকে এই শিথিল অবস্থা থেকে বেরিয়ে আস্তে সাহায্য করে। এই শিথিলতার কারণ ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখার সময় হাত, পা এবং শরীর সচল থাকলে নিজের এবং পাশে শুয়ে থাকা মানুষটির আঘাতের সম্ভাবনা প্রবল। ঘুম দু ধরণের হয়। REM (Rapid eye movement) এবং NON REM। NON REM ঘুমের সময় মস্তিষ্ক শান্ত এবং ধীর গতির হয়ে যায়। REM ঘুমের সময় চোখের গতি বেড়ে যায় এবং মস্তিষ্ক আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই সময়ে মস্তিষ্ক স্বপ্নের জগতে চলে যায়। স্লিপ প্যারালাইসিসে আক্রান্তের ক্ষেত্রে ঘুম থেকে জাগার সময় চেতনা ফিরে আসলেও অঙ্গগুলো পক্ষাঘাতে আক্রান্ত রোগীর মত অসার হয়ে যায়। এই সময় আক্রান্ত কথা বলতে পারে না। ভয়, আতঙ্ক,অসহায় বোধ, দম বন্ধ করা গলা এবং শ্বাসরোধের অনুভূতি হতে থাকে। এই সময়ে আক্রান্ত অমূলক প্রত্যক্ষণ বিভ্রম (Hallucinations)এর শিকার হন। মিসেস সিং এবং মিসেস দাগাদের অনুভব করা অদ্ভুত ঘটনার পিছনে কোন অশুভ ভূত, প্রেত এবং অশরীরীর হাত নেই। ওঁরাও স্লিপ প্যারালাইসিসের শিকার। সাধারণভাবে এটি বিপজ্জনক নয়। তবু যদি এতে কেউ চিন্তিত হয়ে পড়েন তবে আক্রান্তরা এ বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন।

মিঃ সিং এবং মিঃ দাগাদে আমাদের ধন্যবাদ দিলেন ব্যাপারটির সমাধান করার জন্য।

তারপর একদিন আরও ছিলাম সেখানে। আর কোন ঘটনা ঘটে নি।

এই বলে নকা মামা শেষ করলেন ওঁর সেদিনের গল্প।                                             

  ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা স্তম্ভিত। তার মাঝে গোবিন্দ বাবু মামাকে ঠেস দিয়ে বললেন,     “ তাহলে এখন থেকে কারও ভূতের ওঝার দরকার পড়লে আমরা মামার নাম সুপারিশ করতে পারি।”   

এই শ্লেষের পরে মামার মেজাজ বিগড়ানোর আগেই আমরা রওনা দিলাম বাড়ির দিকে।                                     

 চিত্রসূত্র – ইন্টারনেট এবং তার সহায়তায় তৈরি চিত্র