
কল্পবিজ্ঞানের গল্পে যেমনটা আমরা পড়ি যে মহাকাশযানের ভিতরে তাজা অক্সিজেন সরবরাহ করছে আধা গাছ, আধা রোবট-জাতীয় ‘ট্রী-বর্গ’ (সাইবর্গের মত), অথবা কোনো গ্রহে বাচ্চারা গাছের সবুজ পাতা, লিকলিকে সবুজ কাণ্ড, বীজের আকারে থাকা প্রসেসর, এইসব দিয়ে বানানো ‘ফ্লোরাল কম্পিউটার’ চালাচ্ছে, ঠিক তেমনটা আমাদের এই গ্রহে চালু হতে হয়ত খুব বেশি দেরি নেই। বায়োহাইব্রিড টেকনোলজির এই যুগে, আসুন, আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই কর্নেল ইউনিভার্সিটির এঞ্জিনিয়ার গবেষক আনন্দ মিশ্রের সঙ্গে — যিনি বহুদিন ধরেই জীবন-সদৃশ রোবট তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জীবন-সদৃশ রোবট তৈরি করার বিষয়টা এতটাই জটিল যে ল্যাবরেটরিতে আদ্যোপান্ত কৃত্রিম পদার্থ ব্যবহার করে মানুষের জীবন্ত একটা সম্পূর্ণ হাত কিংবা একটা গাছের গোটা সবুজ পাতা তৈরি করা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয় নি। তবে সম্পূর্ণ কৃত্রিম জীবন-সদৃশ রোবট না বানিয়ে যদি রোবট বানানোর কাজে জীবন্ত উদ্ভিদ বা প্রাণীদেহের কলা বা টিস্যু (tissue) ব্যবহার করা হয় তবে বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে। ছোটোবেলায় জীবন-বিজ্ঞান বইতে আমরা পড়েছি যে একই উৎস থেকে সৃষ্ট, একই ধরনের কাজ সম্পন্নকারী সমধর্মী একটি অবিচ্ছিন্ন কোষগুচ্ছকে বলা হয় টিস্যু বা কলা। এদের উদ্দেশ্য হল জীবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ ও তন্ত্র গঠন করা এবং তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। এরাই আমাদের আলো দেখায় বা বোঝায়, উত্তাপ অনুভব করায়, খাবারের স্বাদ, গন্ধ বুঝতে সাহায্য করে; এককথায়, একটা জীবন তার বাইরের পরিবেশ কেমন সেটা অনুভব করতে সাহায্য করে সে জীবদেহের জীবন্ত কলা বা টিস্যু। সুতরাং রোবটকে যদি পরিবেশের বিভিন্ন পরিবর্তন অনুভব করাতেই হয়, তবে এরকম জীবন্ত টিস্যুর সাহায্যেই সেটা করাতে হবে। ঠিক এটা ভেবেই আনন্দ মিশ্র ছত্রাকের টিস্যু ব্যবহার করে একরকম হাইব্রিড রোবট তৈরি করেছেন।
ছত্রাক যদিও আমাদের চিরচেনা সবুজ উদ্ভিদ নয়, তবে কোনো কোনো ছত্রাকের মাইসেলিয়াম (mycelium) নামে মূলের মত একরকম অঙ্গ আছে। মূলের মতই এই মাইসেলিয়ামগুলো (বহুবচনে, মাইসেলিয়া; mycelial) মাটি বা সাবস্ট্রেটের (যার উপর ছত্রাক জন্মায়, যেমন গোবর বা পাঁউরুটি) মধ্যে ফুঁড়ে নেমে যায় আর প্রয়োজনীয় খনিজ লবণ বা অন্যান্য পুষ্টিদ্রব্য সংগ্রহ করে। এমনকি ছত্রাক বাইরের আলো বা উত্তাপ অনুভবও করে এদের সাহায্যে।
আনন্দ মিশ্র আর তাঁর সহযোগী গবেষকরা এইরকম মাইসেলিয়াম-ওয়ালা ছত্রাক চাষ করেছেন সরাসরি একটা ইলেক্ট্রোডের উপরে। ইলেক্ট্রোড হল একরকমের বৈদ্যুতিক পরিবাহী যেটা বৈদ্যুতিক সার্কিটের অধাতব অংশের সাথে (যেমন দ্রবণ, গ্যাস বা জেলির মত কোনো অংশ) যোগাযোগ করতে ব্যবহৃত হয়। ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল কোষগুলোতে, ইলেক্ট্রোডগুলো একরকম প্রয়োজনীয় অংশ এবং কোষের ধরণের উপর নির্ভর করে এগুলো বিভিন্ন ধরণের উপাদান নিয়ে গঠিত হতে পারে। এক্ষেত্রে যে ইলেক্ট্রোডের উপর মাইসেলিয়াম গজিয়েছে সেটা দুটো রোবটের সঙ্গে যুক্ত আছে। তবে এই রোবট বলতে যদি হাত-পা-মাথাওয়ালা কোনো যন্ত্রমানব ভাবেন, তাহলে ভুল করছেন। সাধারণত পরীক্ষার জন্য যে কোনো যন্ত্রকেই রোবটের রূপ দেয়া যেতে পারে। সোজা কথায় রোবট হল এমন একটা যন্ত্র যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারে, যা মানুষের মতো বা মানুষের সাহায্য ছাড়াই জটিল কাজ করতে সক্ষম। এক্ষেত্রে ছত্রাকের মাইসেলিয়া দুটো রোবটের মধ্যে বৈদ্যুতিক সঙ্কেত বা সিগন্যাল (signal) আদান-প্রদানের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করছে। আমাদের স্নায়ুকোষ এবং হৃৎপেশীকোষে ঠিক যেমন সাইন্যাপস্ থাকে, তেমন সাইন্যাপস্ হিসেবেই এই মাইসেলিয়া কাজ করছে।
এক স্নায়ুকোষ থেকে অন্য স্নায়ুকোষে সঙ্কেত পৌঁছায় ইলেকট্রনের মাধ্যমে সাইন্যাপস্ দিয়ে। এর জন্য সাইন্যাপসে, অর্থাৎ স্নায়ুকোষদুটোর সংযোগস্থলে বৈদ্যুতিক বিভবের সামান্য বা অতি সামান্য পার্থক্য থাকা দরকার। এই বিভব-পার্থক্যকে সাধারণভাবে বলা হয় অ্যাকশন পোটেনশিয়াল (Action Potential), কারণ ওটা না থাকলে অ্যাকশন অর্থাৎ কাজ হত না। স্নায়ুকোষের সংযোগস্থল সাইন্যাপসের মতই মাইসেলিয়াম-ইলেকট্রোড সংযোগস্থলে স্বতঃস্ফূর্ত অ্যাকশন পোটেনশিয়াল তৈরি হতে দেখেছেন আনন্দ মিশ্ররা। ছত্রাকেরা রোবটের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছে এই অ্যাকশন পোটেনশিয়াল দিয়েই। রোবটের হাঁটাচলা, ঘুরপাক খাওয়া — সবই মাইসেলিয়ার স্বতঃস্ফূর্ত অ্যাকশন পোটেনশিয়ালের জন্য সম্ভব হচ্ছে। আবার মাইসেলিয়ার উপরে অতিবেগুনি রশ্মি (ultraviolet rays) ফেললে তার অ্যাকশন পোটেনশিয়াল আরো বেড়ে যাচ্ছে আর তার ফলে রোবটদের চলাফেরায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই সমস্ত গবেষণার তথ্য ‘সায়েন্স রোবটিক্স’ নামক গবেষণা-পত্রিকায় ২০২৪ সালে প্রকাশ করেছেন আনন্দ মিশ্ররা। তাঁরা জানিয়েছেন যে ভবিষ্যতে এরকম মাইসেলিয়া দিয়ে রোবট বানিয়ে তার দ্বারা গ্যাসীয় পদার্থের উপস্থিতি শনাক্ত করা সম্ভব কিনা তা নিয়ে পরীক্ষা চালাবেন।
ছিল ছত্রাকের মাইসেলিয়াম, হল রোবটের সংবেদী স্নায়ু (sensory neuron)। আগামী দিনে হয়ত কৃষিক্ষেত্রে এরকম রোবটীয় স্নায়ু ব্যবহার করে ছত্রবট অথবা বটছত্র (shroombot; Mushroom শব্দের shroom আর Robot শব্দের bot) তৈরি করা সম্ভব হবে, যেগুলো চাষের ক্ষেতের কাদার মধ্যে দিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে মাটির অবস্থা আর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবে আর চাষীকে রিপোর্ট দেবে।