কী একটা ভাইরাসজনিত অসুখে গোবিন্দকে অকালে হারিয়ে তার বন্ধু হারাধন শোকে কাতর হয়ে পড়েছিল। দুই বন্ধু ছিল একেবারে যাকে বলে হরিহর-আত্মা! তিন কুলে তাদের আত্মীয়স্বজন বলতে আর কেউ ছিল না। নেপাল বিশ্বাসের মেসের ২২ নম্বর রুমটাই তাদের একমাত্র আস্তানা। আর এ পাড়ার একমাত্র চালু ওষুধের দোকান একমাত্র তাদেরই। দুজনে আগে তেলেভাজার দোকান থেকে শুরু করে হার্ডওয়্যারের ব্যবসা, কী না চেষ্টা করেছে! এখন ঐ ওষুধের দোকানটা খুলে গত কয়েক বছর হল বেশ আয় করছিল। সব গুছিয়ে নিয়ে যখন দুজনেই একটু নিশ্চিন্ত হয়েছে, আর ভাবছে বড় রাস্তার মোড়ে দোকানটা সরিয়ে নিয়ে বেশ বড় আকারে খোলার কথা, তখনই ঘটে গেল এই দুর্ঘটনা।
সব পারলৌকিক ক্রিয়া মিটে গেলেও গোবিন্দর দুঃখে হারাধন মাসখানেক দোকান তো খুললই না, আর খুললেও একটা গা-ছাড়া মনোভাব নিয়ে বিক্রিবাটা চালাচ্ছিল। তিন মাস পরে আমরা পাড়ার সবাই হারাধনকে বুদ্ধি দিলাম, পাশের পাড়ার বিখ্যাত বিজ্ঞানী রমাকান্ত কামারের কাছে যেতে। রমাকান্ত সম্প্রতি নিজে মাথা খাটিয়ে একটা টাইম মেশিন বানিয়েছিলেন। ওটা দিয়ে যদি গোবিন্দর সঙ্গে হারাধন দেখা করে একবার কথা বলে আসে তো তার দুঃখ কিছুটা হলেও কমে।
দোলের পরেরদিন হারাধনের দোকানে অম্বলের ওষুধ আনতে গিয়ে চমকে উঠলাম। অবিকল গোবিন্দর মত দেখতে একটা ছেলে হারাধনের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছে। হারাধনকে তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে সে মুচকি হেসে বলল, "রমাকান্ত স্যারের বিস্ময়কর সৃষ্টি। গোবিন্দর এ.আই. অ্যাভাটার, অর্থাৎ artificial intelligence অবতার। আমার মুখে গোবিন্দর স্বভাব-চরিত্র, কথাবার্তা, হাঁটাচলার কায়দা এইসব শুনে শুনে উনি এই হিউম্যানয়েডটা বানিয়ে দিলেন, বুঝলি। পরীক্ষা পর্যায়ে আছে বলে দামটাম নেন নি। একবার কথা বলেই দ্যাখ না, হুবহু গোবিন্দ ফিরে এসেছে! আমার যে কী শান্তি হচ্ছে বলে বোঝাতে পারব না।"
আমি গিয়ে গোবিন্দকে, মানে গোবিন্দর এ.আই. অবতারকে জিজ্ঞেস করলাম, "কি রে গোবিন্দ, কোথায় গেছিলি বল্ তো? বেচারা হারাধন তো তোকে ছাড়া চোখে সর্ষেফুল দেখছিল! তা শরীর-টরীর এখন ভালো তো, যা ভাইরাল জ্বরে ভুগেছিলিস কয় হপ্তা!"
অবতার হুবহু গোবিন্দর মত তাকিয়ে একেবারে গোবিন্দর আসল গলায় কথা বলে উঠল, "ভাইরাল জ্বরে? ধুস্! সালমোনেলা, গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া। এন্ডোটক্সিন।"
আমি দারুণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, "মানে! ওরে হারাধন, গোবিন্দ কী সব বলছে রে?"
হারাধন মুখ চুন করে জানায়, "পটলা রে, ঐ একটাই গ্লিচ্ থেকে গেছে গোবিন্দর সিস্টেমে। কাল থেকে যে যাই জিজ্ঞেস করে, তার ঐ এক উত্তর। তবে রমাকান্ত স্যারের কাছে নিয়ে গেলে মনে হয় সমস্যা মিটে যাবে। এইসব সফটওয়্যার আপডেট রাখার বহুত ঝক্কি।"
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "বলিস কি? তা একটা মরা মানুষকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে জ্যান্ত করার পিছনে তো শতশত লোক রাতদিন কাজ করে চলেছে বলেই জানতাম। আমাদের রমাকান্ত বিজ্ঞানী এত লোক কোথায় পেলেন রে? এত কোম্পানির ব্যবসা বলে মনে হচ্ছে!"
হারাধন মুচকি হেসে বলল, "আরে, লোক কোথায়, ওগুলোও এ.আই.! রমাকান্ত এমন এ.আই. তৈরি করে দিয়েছেন যেটা আগামী অন্ততঃ বছর পাঁচেক নিজের আপডেট নিজে খুঁজে ইন্সটল করে নিতে পারবে। কিন্তু সমস্যা সেটা নয়। গোবিন্দর যে বায়োমেট্রিক আর জেনেটিক ডেটা দিয়ে হিউম্যানয়েডটা বানানো হয়েছে, সেই ডেটা ওর বেঁচে থাকার সময় পর্যন্ত। এতদিন সব হিউম্যানয়েড এইভাবে বানানো হয়েছে। রমাকান্ত স্যার আবিষ্কার করেছেন এমন টেকনোলজি যে গোবিন্দ বেঁচে থাকলে কী কী করতে পারত, তা অটোমেটিক আপডেট নিয়ে নেবে এ.আই.। এবং ওনার দাবী, সেই কাজগুলো মোটেই তাঁর কল্পনা নয়। মাঝেমধ্যে ঐগুলো প্রসেসিং করতে সময় নিচ্ছে আর তার জন্য বোধহয় ওরকম উল্টোপাল্টা বকছে গোবিন্দটা।"
আমি ঘাবড়ে গিয়ে গোবিন্দকে বললাম, "কী সাংঘাতিক! গোবিন্দ রে, তুই যে অমর হয়ে গেলি!"
গোবিন্দ স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ আমার আর হারাধনের কথা শুনছিল। এবার বলল, "সিজিয়াম ব্যাটারি যতক্ষণ, আমার আয়ুও ততক্ষণ। তার মধ্যেই আমি প্রতিশোধ নেব। সালমোনেলা। এন্ডোটক্সিন। একটা গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার উদাহরণ দে তো পটলা!"
হারাধন তাড়াতাড়ি গোবিন্দকে থামিয়ে দেয়। একটা মৃদু ধমক দিয়ে বলে ওঠে, "ওরে থাম। পরে দেখছি তোর ব্যাকটেরিয়া। এখন উপরের তাক থেকে ডাইজিনের বাক্সটা পাড় দিকি!"
সেদিনের মত ওষুধ কিনে বিদায় নিলাম। পরেরদিন একটা কাজে দিল্লি যেতে হল। ফিরলাম এক হপ্তা পরে। বাড়ি ফিরেই শুনি সাংঘাতিক কান্ড!
হারাধন খুন হয়েছে! নিজের মেসের রুমেই। গোবিন্দর এ.আই.-এর হাতে। হিউম্যানয়েডটা খুন করে রক্ত মেখে রুমেই বসে ছিল। নেপাল বিশ্বাসের মেসে পুলিশ এসেছে। খুনী সামনে থাকা সত্ত্বেও গ্রেপ্তার করা যায় নি। কারণ এ.আই.-কে বিচার করার সঠিক আইন এখনো এদেশে তৈরি হয় নি। বিজ্ঞানী রমাকান্ত কামারের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা রুজু করেছে সরকার। হেভিওয়েট লোক। তবে তদন্ত চলছে। নিউজ চ্যানেলে দেখাচ্ছে গোবিন্দর অবতারটা এমন ভয়ানক কাজ করেও নির্লিপ্ত ভাবলেশহীন মুখে বসে আছে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর গবেষণাগারে।
তিন বছর পরে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো চাঞ্চল্যকর তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করল। গোবিন্দকে বিষ প্রয়োগ করে খুন করেছিল হারাধন। বিষটা বানিয়েছিলেন রমাকান্ত নিজের ল্যাবরেটরিতে। সালমোনেলা নামের গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার এন্ডোটক্সিন। এ.আই. দিয়ে সিন্থেসিস করানো হয়েছিল। ব্যাকটেরিয়াটার প্রাকৃতিক বিষের চাইতে আরো তীব্রতর হয়েছিল এই বিষাক্ত লাইপোপলিস্যাকারাইড। কোনভাবে গোবিন্দর শরীরে ঢুকে এমন জ্বর বাধায় যে ডাক্তার রক্ত রিপোর্ট দেখেও ভেবেছিলেন ভাইরাল ইনফেকশন। প্যাথোলজিস্টের দোষ ছিল না। বিষটা চেনার মত উপযুক্ত রাসায়নিক আবিষ্কার হয় নি যে!
সব খুনের পিছনে খুনীর একটা স্থির উদ্দেশ্য থাকে। এখানেও তার অন্যথা ছিল না। ওষুধের দোকানের লাভের গোটা অংশটা আর কারো সঙ্গে ভাগ করতে রাজি ছিল না হারাধন। তবে রমাকান্তকে মোটা টাকা দিয়ে প্ল্যানে সামিল করতে হয়েছিল। মতলব ছিল, গোবিন্দর দুঃখে কুম্ভীরাশ্রু দেখিয়ে হারাধন একদিন দেখাবে যে দোকান আর চলছে না। তারপর সবার অগোচরে সব মালকড়ি নিয়ে এলাকা ছেড়ে পালাবে। অন্যত্র বেনামে রমাকান্ত নিজের এ.আই. কোম্পানি খুলবে। সেই কোম্পানিতে গিয়ে জুটবে হারাধন। আমরা চাপাচাপি করাতে রমাকান্তর সাহায্যে পরীক্ষামূলকভাবে গোবিন্দর একটা অবতার বানিয়ে কয়দিন দোকানটা চালানোর ভান করছিল।
বাদ সাধল রমাকান্ত বিজ্ঞানীর নিজেরই বুদ্ধি। শেষতক যদি ঐ অটোমেটিক আপডেটের ব্যাপারটা না জুড়ত গোবিন্দর সফটওয়্যারে, তাহলে হয়ত হারাধন নিজে খুন হত না। গোবিন্দর এ.আই. গোবিন্দ বেঁচে থাকলে যেটা করত, সেই প্রতিশোধ ঠিকই নিয়েছে। এবং হয়ত রমাকান্তকেও মেরে ফেলত, যদি না তার সিজিয়াম ব্যাটারির চার্জ শেষটায় ১০%-এ নেমে না আসত।
তবে হারাধন একটা কথা সম্পূর্ণ চেপে গেছিল। গোবিন্দর এ.আই. -এর সাবলীল কাজকর্ম আর আপডেটের পিছনে অনেক মানুষ কাজ করেছে। হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স ছাড়া কি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হয় নাকি? মজার ব্যাপার হল, যারা কাজগুলো করত তারা আদৌ জানত না যে তারা একসঙ্গে একটাই বড় কাজ করে চলেছে। এতটাই সূক্ষ্ম পরিকল্পনা করে কাজ করাত রমাকান্ত, থুড়ি, তার কোম্পানি — "টোটাল ইন্টেলিটন"।
আপাতত পুলিশ আর সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে বিজ্ঞানী রমাকান্ত কামার ফেরার। ভগবান জানেন, অন্য কোন্ দেশে কী ছদ্মনাম ধরে তিনি আবার কোন্ মানুষের এ.আই. অবতার বানিয়ে বেড়াচ্ছেন! শুধু নজর রাখতে হবে, আশেপাশের কোনো মরা মানুষ বেমক্কা জ্যান্ত হয়ে ফিরে এসেছেন কিনা। যদি এরকম কোনো ব্যাপার আপনাদের চোখে পড়ে, অবশ্যই সাবধান হয়ে যাবেন; কারণ হয়ত তার আশেপাশেই কোথাও বিজ্ঞানী রমাকান্ত কামারের 'ইন্টেলিটন' নামের কুখ্যাত কোম্পানি কিংবা ল্যাবরেটরিটা থাকতে পারে!
চিত্রসূত্র – ইন্টারনেট