সূচিতে ফিরুন

সৌরকলঙ্ক, চেনালেন আকাশপ্রেমী ডাক্তার

লেখক - ড.সৌমিত্র চৌধুরী
img

‘খ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশ পাথর’। কত দিন খোঁজে? সপ্তাহ মাস বছর, বছরের পর বছর! আকাশে চোখ রেখে দুই দশক ধরে তিনি কেবলই খুঁজতেন। কী খুঁজতেন, কী বা পেলেন? আশ্চর্য মানুষ আর তার অদ্ভুত গল্প।

সে অনেক দিন আগে। ২৩০-৪০ বছর তো হবেই। জার্মানি স্বাধীন দেশ তখন। রোমান সাম্রাজ্যের আওতা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন দেশ গঠন করেছে। তার মধ্যেই টিকে আছে বেশ ক’টা স্বাধীন রাজ্য। প্রুশিয়া, ব্যাভারিয়্ স্যাক্সনি ও অস্ট্রিয়া। তারা এতটাই স্বাধীন যে অন্য দেশ নিজের দখলে রাখতে পারত। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে বিজ্ঞান ও শিক্ষায় উন্নতি শুরু হল জার্মানির। প্রুশিয়া রাজ্যের রাজধানী বার্লিন, জার্মানি দেশকে নিয়ন্ত্রণ করত। রাজধানী বার্লিনে তৈরি হল নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়। এর অনেক পরে বিসমার্কের নেতৃত্বে জার্মান জাতি সংবদ্ধ হয়েছিল (১৮৭১)। গণতান্ত্রিক জার্মানি শাসনের জন্য তৈরি হয়েছিল পার্লামেন্ট (Reichstag)। তার পরিচালনার জন্য লিপিবদ্ধ হয়েছিল অনেক আইন-কানুন।

ভারতের অবস্থা তখন মর্মান্তিক। মোঘল সম্রাটদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লুটপাট চালাচ্ছে দেশ জুড়ে। মড়ক আর মন্বন্তরে মারা পড়ছে ভারতীয়রা। পঁচিশ বছরে (1876 to 1901) দুর্ভিক্ষ হয়েছে তিন বার। দেশে ধূমায়িত হচ্ছিল অসন্তোষ। যার পরিণতি স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৮৫৭)। যুদ্ধে হেরে গিয়ে ব্রিটিশ একচ্ছত্র ক্ষমতায় এল। এর অনেক পরে ঘটল বাংলার নবজাগরণ। পুরোধা রাজা রামমোহন রায়, জন্ম ১৭৭২। নবজাগরণের সময় থেকেই আধুনিক বিজ্ঞান চর্চা শুরু হল বাংলা তথা ভারতের বুকে।

ভারত-ইতিহাসের এসব কথা হয়ত তেমন প্রাসঙ্গিক নয়। বলতে চাইছি দু’শো তিরিশ বছর আগের (১৭৮৯-১৮৭৫) সমকালীন সময়ের অন্য দেশের এক বিজ্ঞানীর কথা। জার্মানির এক ডাক্তার, তিনি আবার সখের জ্যোতির্বিদ। নাম হেনরিখ স্যামুয়েল সোয়াব (Heinrich Samuel Schwabe, 1789-1875)।

জন্ম জার্মানির সক্সনি প্রদেশে (২৫ শে অক্টোবর, ১৭৮৯)। যে শহরে জন্ম তার নাম ‘দেশাও’ (Dessau)। হেনরিখ সোয়াবের বাবা (Johann Gottlob) ডাক্তার। শহরের রাজকুমার ডিউক, তারও (Leopold III Frederick Franz) চিকিৎসা করতেন। ছেলেটির, মানে হেনরিখ স্যামুয়েল সোয়াবের মায়ের বাবাও ছিলেন ডাক্তার। সোয়াবরা এগার ভাইবোন। হেনরিখ সোয়াব জ্যেষ্ঠ। ছেলেটির দাদু (মায়ের বাবা) চাইতেন তার বড় নাতি সোয়াব যেন খুব বড় ডাক্তার হয়। দাদুর নাম হেসলার (Haeseler)। হেসলারের নিজস্ব একখানা দাওয়াখানা (Mohrenapotheke) ছিল। সেখানে অনেক ধরনের রোগের চিকিৎসা করতেন তিনি।

বাবা-মা এবং দাদুর ইচ্ছায় সেই দাওয়াখানা যোগ দিলেন সোয়েব। স্কুলের পাঠ শেষ করে ১৭ বছর বয়সে চিকিৎসায় তার শিক্ষানবিশি শুরু হল। তিন বছর দাদুর তত্ত্বাবধনে ডাক্তারি বিদ্যার অনেক শিক্ষা রপ্ত করলেন। তারপর গেলেন দূরের শহর বার্লিনে। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে শরীরতত্ত্ব পড়তে। সেই সঙ্গে উদ্ভিদবিদ্যা আর জ্যোতির্বিদ্যার ক্লাশ গুলোতে অধ্যাপকদের লেকচার মন দিয়ে শুনতেন।

বার্লিন থেকে ডাক্তারির ডিপ্লোমা নিয়ে নিজের শহরে ফিরে এলেন সোয়েব। একুশ বছরের যুবক। তার দাদু ডাক্তার হেসলার অসুস্থ তখন। বছর খানেক পরে মারা গেলেন। দাদুর চিকিৎসা কেন্দ্রের ভার এসে পড়ল বাইশ বছরের তরুন সোয়াবের কাঁধে। সেই সঙ্গে নিজের পরিবারের ভরণ পোষণের দায়িত্বও। তের বছর ধরে মা এবং ভাইবোনদের দেখাশোনা করলেন সোয়েব। পরিবারে কোনো রকম অর্থকষ্ট হতে দেননি তিনি।

হঠাৎ বদলে গেলেন সোয়েব। ডাক্তারিতে মন নেই। অর্থ উপার্জন ভালো লাগছে না। অন্য কিছু করবার বাসনা উঁকি দিচ্ছে মনে। আকাশ দেখার নেশা পেয়ে বসল তাঁকে। জ্যোতির্বিজ্ঞান বরাবরই তার প্রিয় বিষয়। কয়েক বছর আগে লটারিতে বেশ ভালো মানের একটা বাইনাকুলার পেয়ে গেছিলেন। যন্ত্রটা দিয়ে আকাশের নক্ষত্র দেখতে পাওয়া যায়। আরও ভালো করে গ্রহ তারা দেখবার জন্য মিউনিখের এক নামকরা দোকান থেকে রিফ্র্যাক্টিং টেলিস্কোপ (refracting telescope) নামের একটা যন্ত্রও কিনে ফেললেন। ডাক্তারির চাপে যন্ত্র গুলো তেমন ভাবে ব্যবহার করা হয়নি। এখন ব্যবহার করা শুরু করলেন। অন্য কাজ ছেড়ে দিয়ে দিনরাত শুধু আকাশ দেখা।

সব সময় বাইনাকুলারে চোখ। যত দেখছেন আকাশ, জোরদার হয়ে পড়ছে নেশা। আকাশ দেখার নেশা। দাদুর যাবতীয় সম্পত্তি, দাওয়াখানা বিক্রি করে দিলেন। অনেক টাকা হাতে এল। ১৮০০০ ট্যালের। সেই সময়কার প্রাশিয়া সরকারের রৌপ্য মুদ্রা (Taler)।

বাড়ির ছাদে উঁচু মানের এক আকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (astronomical observatory) বসিয়ে ফেললেন সোয়েব। সে দিয়েই আকাশের চাঁদ সূর্য গ্রহ তারা দেখতেন।

টেলিস্কোপ যন্ত্রটা আরও উন্নত করে ফেললেন। ছয় ফুট ফোকাল লেংথের একটা টানেল যোগ করলেন এর সঙ্গে। জার্মানির নামকরা জ্যোতির্বিদ লোরম্যান (Wilhelm Gotthelf Lohrmann, 1796-1840) এই যন্ত্র ব্যবহার করতেন। তিনিই (W. G. Lohrmann) টেলিস্কোপ দিয়ে দেখে প্রথম চাঁদের ম্যাপ এঁকেছিলেন। সেই যন্ত্রই হাতে পেলেন সোয়েব।

দিনরাত গ্রহ তারা পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন সোয়েব। ডাক্তারিতে মনোযোগ নেই। আকাশ দেখার নেশায় বুঁদ। ভরা আসমানে চাঁদ সূর্য গ্রহ তারার হাল হকিকত নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করলেন (১৮২৫) ছত্রিশ বছর বয়সী ডাক্তার। এক বছরের পর্যবেক্ষণ, ৬০০ পাতার পর্যবেক্ষণ-লব্ধ তথ্য।

কয়েকজন জ্যোতির্বিদ কাজের প্রশংসা করলেন বটে তবে সোয়েবের সেই রিপোর্ট তেমন সাড়া ফেলতে পারল না। সে সময়ের এক জ্যোতির্বিদ হারডিং (K. L. Harding) সোয়েবকে উৎসাহ দিতেন বুধ গ্রহের উপগ্রহ খুঁজে বেড়াতে। কিন্তু সোয়েবের মাথায় ঘুরত সূর্যের ছবি। সূর্যের গায়ে একরকম দাগ দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। কী এই দাগ? এত দিন জানত না কেউ।

সূর্যের দাগ বা কলঙ্কের রহস্য নিয়ে সর্বদা বুঁদ হয়ে থাকতেন সোয়েব। এতটাই যে নিজের কথা, ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনা কিছুকেই আমল দিতেন না। বিয়ে করলেন প্রৌঢ় বয়সে (১৮৪১), সব কাজকর্ম মিটে যাবার পর। তখন তার বয়স ৫২ বছর।

এর দু’বছর পর খুব বড় একটা কাজ করে ফেললেন সোয়েব। তাঁর দুই দশকের (১৮২৬-১৮৪৩) সূর্য-পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট প্রকাশ করলেন। কী সেই রিপোর্ট? সূর্যের গায়ে লেগে থাকা ছোপ ছোপ দাগ, মানে সৌর কলঙ্কের কাহিনী। বিস্ময়কর তথ্য। অজানা রহস্যের সুলুক সন্ধান নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট। সতের বছর ধরে প্রতিটি দিন সূর্যের গতিবিধির উপর নজর রেখে ছবি গুলো এঁকেছেন। অসীম যত্নে ফুটিয়ে তুলেছেন সূর্যের গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কালো দাগ, মানে সানস্পট গুলোর অবস্থান।

নিখুঁত তাঁর পর্যবেক্ষণ (১৮২৫)। বললেন, দাগ গুলো বিশাল আকারের, অন্তত হাজার মাইল। আর গুণে গুণে বললেন, প্রতিদিন বাড়ছে দাগগুলোর সংখ্যা। বাড়তেই থাকছে। বাড়তে বাড়তে সর্বোচ্চ সংখ্যায় পৌঁছে আবার কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ একসময় মিলিয়ে গিয়ে আবার বাড়তে আরম্ভ করে, আবার কমে যায়। এভাবেই চলে একেকটা চক্র (Cycle)। চক্রের স্থায়িত্বকাল দশ বছর সাত মাস।

সখের জ্যোতির্বিদের কথায় আমল দেয়নি কেউ তখন। পরে অন্য কয়েকজন বিজ্ঞানী (Wolf, Sabine, Gautier and J. von Lamont) তাদের পর্যবেক্ষণে এমন ঘটনাই দেখলেন। কয়েক দশক পর বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী হামবোল্ট (Friedrich Wilhelm von Humboldt, 1769-1859) জানালেন, ডাক্তার শোয়েবের পর্যবেক্ষণ একদম সঠিক। সূর্যের গায়ে লেগে থাকা কালো দাগ গুলো ফুটে ওঠে, আবার মিলিয়ে যায়। সূর্য অস্ত যাবার কালে, যখন উজ্জ্বলতা কম, এই দাগ খালি চোখেও নজরে আসে।

সূর্য সম্পর্কে মানুষের কৌতূহল বরাবরই খুব বেশী। বর্তমান সময়ে আরও বেড়েছে। ইদানীং কৃত্রিম উপগ্রহ বানিয়ে সূর্যের অনেক কাছের ছবি তুলে আনতে পারছে। তবুও সূর্যের পুরোটা জানা যাচ্ছে না। জানা দরকার কারণ সৌর ঝড়ের প্রভাব পৃথিবীতেও এসে পড়ছে।

সৌর ঝড়, সৌর চুম্বক এ সব রহস্যের মূলে আছে সূর্যের গায়ে লেগে থাকা সেই কালো দাগ। যেগুলো সম্পর্কে দুশো বছর আগে প্রথম বলে গেছিলেন সখের জ্যোতির্বিদ ডাক্তার হেনরিখ সোয়াব। সূর্য নিয়ে আলোচনা হলেই সৌর দাগের কথা ওঠে। আর ওঠে আসে ডাক্তার হেনরিক সোয়াবের কথা।

শুধু জ্যোতির্বিদ্যা নয়। আকরিক বিদ্যাতে (Mineralogy) পারদর্শী ছিলেন সোয়াব। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পশু পাখি গাছপালার খবর সংগ্রহ করতেন। প্রকৃতি চর্চায় এমন অবদান তাঁর, ভাবলে বিস্ময় জাগে। স্থানীয় প্রকৃতি চর্চা সংগঠনের সভাপতি ছিলেন তিনি। নিজের এলাকার যাবতীয় উদ্ভিদ এবং আকরিক (Minerals) সংগ্রহ করে রাখতেন। বহু ধরনের গাছের (২৪০০ রকম) বিবরণ দিয়ে “Flora Anhaltina" নামের দু’খণ্ডে বই লিখেছিলেন (1838) সোয়াব।

সোয়াবের প্রধান উৎসাহ ছিল জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়টিকে ঘিরে। জ্যোতির্বিদ্যার সর্বোচ্চ সংস্থা রয়াল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি (RAS) তাঁকে সম্মানিত করেছিল (১৮৫৭)। তাঁর হাতে স্বর্ণ পদক তুলে দিয়েছিলেন সেই সময়কার বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ক্যারিংটন। পরবর্তী সময়ে এই সংস্থার সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন সোয়াব (১৯৬৮)। সোয়াবের মৃত্যুর পর (১৮৭৫) সূর্য সম্পর্কিত তাঁর বেশির ভাগ লেখা প্রকাশ করেছিল রয়াল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি। লন্ডনে এই সংস্থার হেপাজতে (Burlington House) সযত্নে রাখা আছে মানব জাতির উদ্দেশে তুলে দেওয়া সোয়াবের অমূল্য সম্পদ। বিয়াল্লিশ বছর আকাশ পর্যবেক্ষণের ২৭ খণ্ডে লেখা দলিল।

জার্মানির দেশাও শহরে সোয়াবের বাড়ি, ১৮ নম্বর যোহানেস স্ট্রস, বিজ্ঞানী তথা সাধারণ মানুষের দর্শনীয় স্থান। পুরনো বাড়ির ছাদে সেই আকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হোয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানি ঐক্য বদ্ধ হবার পর অনেক ব্যবসায়ী চেয়েছিলেন বাড়িটা মাটিতে গুঁড়িয়ে দিয়ে হাল ফ্যাশনের শপিং মল বানাবেন। বিজ্ঞান প্রিয় মানুষজন সে রকম হতে দেননি। তাদের যত্নে শতাব্দী প্রাচীন বাড়ি টিকে আছে আগের মহিমায়।

জার্মানির পোস্টকার্ডে সেই অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল স্টেশন। দেশাও নগরীর মাঝখানে বিজ্ঞানী হেনরিখ স্যামুএল সোয়াবের বাড়ি। -০-

[লেখক পরিচিতিঃ Dr. Soumitra Kumar Choudhuri, M.Sc., Ph.D., এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট ও বিভাগীয় প্রধান (প্রাক্তন), চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা-700026; ভ্রাম্যভাষঃ 9831046252; E-mail: soumitrag10@gmail.com]

জার্মানির পোস্ট কার্ডে বিজ্ঞানী হেনরিখ স্যামুএল সোয়াবের বাড়ি তথা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল স্টেশন।

সূচিপত্র