সূচিতে ফিরুন

গ্লুয়ন– আঠার মতো এক মৌলিক কণা

লেখক - ইন্দ্রনীল মজুমদার
img

সমস্ত কিছুই পরমাণু দিয়ে গড়া। আমাদের মহাবিশ্বের যা কিছু রয়েছে সবই। এই পরমাণুর কেন্দ্রে রয়েছে নিউক্লিয়াস যা প্রোটন ও নিউট্রনদের ঘর। অর্থাৎ, নিউক্লিয়াসে রয়েছে ধনাত্মক আধারযুক্ত প্রোটন এবং আধারহীন নিউট্রন কণা। এই নিউক্লিয়াসের চারপাশে বিভিন্ন কক্ষে ঋণাত্মক আধারযুক্ত ইলেকট্রনরা ঘুরে বেড়ায়। সে যাই হোক, ইলেকট্রনরা ঘুরে বেড়াক। এই প্রোটন ও নিউট্রন হল ব্যারিয়ন কণার অন্তর্ভুক্ত। আবার এই ব্যারিয়ন কণা হ্যাড্রন কণা শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। হ্যাড্রনের অপর অংশের নাম মেসন কণা। আসলে, হ্যাড্রনরা কোয়ার্ক নামক এক মৌলিক উপাদান দ্বারা গঠিত। ব্যারিয়নরা তিনটি কোয়ার্ক দ্বারা গঠিত এবং মেসনরা এই যেমন পায়ন, কাওন ইত্যাদিরা একটি কোয়ার্ক ও একটি অ্যান্টিকোয়ার্ক দ্বারা গঠিত। এখন বিষয়টা হচ্ছে এই যে হ্যাড্রনের মধ্যে যে কোয়ার্কগুলো রয়েছে তাদের ধরে রেখে রাখছে কে? অর্থাৎ আঠার মত কোয়ার্কগুলোকে চিপকে রেখে প্রোটন, নিউট্রন কণাগুলো তৈরি করছে কে? এই আঠার মতো করে কোয়ার্কগুলোকে একত্রিত রাখছে ও রেখে নিউট্রন, প্রোটনদের মতো হ্যাড্রন কণা তৈরি করছে গ্লুয়ন নামক এক মৌলিক কণা। আঠার মতো কাজ করছে বলে এর নাম দেওয়া হয়েছে গ্লুয়ন (Gluon)। এরাই কোয়ার্কগুলোকে চিপকে রেখে বড় বড় কণাগুলোকে তৈরি করে। এরা অন্যান্য কোয়ার্কদের মধ্যে সবল নিউক্লিয় বল (strong nuclear force/ strong force/ strong interaction) বহন করে বেড়ায় আর তাই শক্তিশালী বল দ্বারা বেঁধে রাখে কোয়ার্কদের। সেই কারণে এই গ্লুয়নকে বলা হয় বল বহনকারী মৌলিক বা অতি-পারমাণবিক কণা।

গ্লুয়নের সাথে তুলনা করা যায় ফোটন (Photon) কণার। গ্লুয়নের মতো সেও এক ধরণের বলের বাহক আর সেই বল হল তড়িৎচুম্বকীয় বল(Electromagnetic force)। আসলে, এরা বল বহনকারী মৌলিক কণা আর এরা বোসন (Boson) কণার অন্তর্ভুক্ত। তাই এরা বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যায়ন (Bose-Einstein Statistics) অনুসারে চলে। বোসন কণাদের মতো গ্লুয়নের ঘূর্ণন বা স্পিন পুর্ণসংখ্যা হয়। এই যেমন গ্লুয়নের স্পিন হল 1। অর্থাৎ, গ্লুয়নের ঘূর্ণনের পরিমাণ বা স্পিন বলতে আমরা বুঝি যে, একটি নির্দিষ্ট অক্ষের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে একটি পূর্ণ ঘুর্ণন সম্পন্ন করতে এরা একটি নির্দিষ্ট সময় নেয়।

পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভেতরে থাকা প্রোটন ও নিউট্রনের ভেতরে থাকা কোয়ার্কের উপস্থিতির ধারণাটি উঠে আসে কোয়ার্ক মডেলের উদ্ভবের সাথে। প্রোটন ও নিউট্রন গঠন করেছে যারা সেই কোয়ার্কদের একত্রে ধরে রাখার জন্য একটি বলের প্রয়োজন। আর এই প্রয়োজনের তাগিদে বল বহনকারী মৌলিক বোসন কণা গ্লুয়নের ধারণাটি আসে। যদিও প্রকৃতিতে গ্লুয়ন সর্বদা বিদ্যমান তবুও এই কণা নিয়ে অধ্যয়ন করা বেশ কঠিন। বিভিন্ন কণা ত্বরকে পরিচালিত পরীক্ষার মাধ্যমে গ্লুয়নের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। কণাপদার্থবিজ্ঞানীরা এদের সম্পর্কে জানতে পেরেছে কেবলমাত্র কণা সংঘর্ষক (particle collider) যেমন CERN-এর লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার থেকে। গ্লুয়নরা এতই ক্ষুদ্র যে তাদের কোয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য প্রায় 2 ট্রিলিয়ন ডিগ্রি তাপমাত্রা যুক্ত শক্তির প্রয়োজন বলে অনুমেয়। এত শক্তি পাওয়া যাবে কোথায়?

গ্লুয়ন সবল মিথস্ক্রিয়ার বা শক্তিশালী বলের বাহক কণা। এটি রং আধান বহন করে। আর এই রং আধানই কোয়ার্কগুলোকে একত্রিত করে রাখে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, মহাবিশ্বের উৎপত্তির পরের মুহূর্তগুলোতে কোয়ার্ক-গ্লুয়ন প্লাজমা অবস্থায় বিরাজ করছিল। এই প্লাজমা থেকেই পরবর্তীতে নিউট্রন, প্রোটন ইত্যাদি হ্যাড্রন কণা তৈরি হয়েছিল।

এবার আমরা আলোচনা করব গ্লুয়নের তাৎপর্যতা নিয়ে। কেন গ্লুয়ন কণা এত জরুরী সেই বিষয় নিয়ে। এই মহাবিশ্বের কাঠামো গঠনের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই গ্লুয়ন। এই গ্লুয়নরা কোয়ার্কগুলোকে একসাথে বেঁধে রাখে এবং এই বেঁধে রাখার ফলেই প্রোটন ও নিউট্রনদের মতো হ্যাড্রন কণা তৈরি হয়। এই প্রোটন ও নিউট্রন মিলেই পরমাণুর নিউক্লিয়াস গঠন করে এবং আমাদের চারপাশের দৃশ্যত কি অদৃশ্যত সকল বস্তুই পরমাণু দ্বারাই তৈরি। তাই, আমরা বলতে পারি যে, আমরা যে বস্তুজগৎ দেখি তথা এই মহাবিশ্বের অস্তিত্বই থাকত না গ্লুয়ন ছাড়া। এই মৌলিক কণা ভর জোগানদার ‘ঈশ্বর কণা’ ওরফে হিগস্‌ বোসনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, গ্লুয়ন আঠার মতো কোয়ার্কগুলোকে ধরে না থাকলে নিউট্রন ও প্রোটন থাকত না, নিউট্রন ও প্রোটন না থাকলে পরমাণুর নিউক্লিয়াস থাকত না। পরমাণুর নিউক্লিয়াস না থাকলে পরমাণুই থাকত না। পরমাণু না থাকলে অণু থাকত না। অণু না থাকলে বস্তু গঠন হত না আর এই বস্তুর গঠন না থাকার ফলে অবশেষে আমাদের অস্তিত্বই থাকতো না যে!

________________________________________

সূচিপত্র