
আধুনিক রসায়নবিজ্ঞানের পথিকৃৎ তিনি। আন্তয়েন-লরেন্ট দ্য ল্যাভয়সিয়ের। মধ্যযুগে রসায়নে বিপ্লবের মধ্যমণি। শুধু রসায়নবিজ্ঞানীই নন; একজন দক্ষ প্রশাসক, ফ্রান্সের কৃষি, আর্থিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের অন্যতম রূপকার। সাধারণ তাপমাত্রায় অক্সিজেন এক গ্যাসীয় মৌলিক পদার্থ, জল হচ্ছে অক্সিজেনের সঙ্গে হাইড্রোজেন মিলিত হয়ে উৎপন্ন এক যৌগিক পদার্থ, নাইট্রোজেন এক গ্যাসীয় মৌলিক পদার্থ ; এমন সব বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাঁরই হাত ধরে। রাসায়নিক পরীক্ষাপদ্ধতিকে উন্নততর, রাসায়নিক পদার্থের নামকরণ ইত্যাদি বহু বিষয়ে রয়েছে তাঁর বহুমুখী অবদান। ভাবতে বিষ্ময় জাগে, সেই তাঁকেই কিনা ফরাসী বিপ্লবের সময় গিলোটিনে প্রাণ দিতে হয়েছিল! ধারালো ভারী ধাতুর পাত উপর থেকে নেমে এসে এক লহমায় মুন্ডচ্ছেদ করেছিল তাঁর। যে ঘটনায় ব্যথিত মর্মাহত বিশিষ্ট গণিতজ্ঞ জোসেফ-লুই ল্যাগরাঞ্জ মন্তব্য করেছিলেন, “এক মুহূর্তে ভূলুণ্ঠিত হল যে মস্তক, অমন একখানা মস্তিষ্ক তৈরি করতে আরো শতবর্ষ অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। ”
২৬ আগস্ট ১৭৪৩, ফ্রান্সের প্যারিস শহরে জন্মগ্রহণ করেন আন্তয়েন-লরেন্ট দ্য ল্যাভয়সিয়ের। পিতা জ্যাঁ -আন্তয়েন ল্যাভয়সিয়ের, মাতা এমিলি পাঙ্কটিস। এগার বছর বয়সে ভর্তি হন বিখ্যাত ম্যাজারিন কলেজে। আর্টস ও চিরায়ত সাহিত্যের পাঠ গ্রহণ করবার জন্য ভর্তি হলেও, পিতা ও বিশেষ করে মাতুলের চাপে আইনের পাঠ গ্রহণ করেন। ১৭৬৩ সালে আইনের ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তাঁর পিতা ও মাতুলের মত অভিজাত অর্ডার অব ব্যারিস্টার হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হন; এর সদস্যরা প্যারিস হাইকোর্টে বিভিন্ন কেস উপস্থাপিত ও পরিচালনা করতে পারতেন। বিপুল প্রতিপত্তি অর্থাগম ও প্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ। কিন্তু বিজ্ঞান তখন তাঁর অন্তরাত্মাকে ডাকছে। নিয়মিত গুইলাউমে ফ্রানকোয়িস রাঊল্লের রসায়ন ও খনিজ পদার্থ সম্পর্কে জনপ্রিয় বক্তৃতা শুনতেন। ল্যাভয়সিয়েরের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রতি ভালবাসাকে আরো জাগিয়ে তোলেন, পারিবারিক বন্ধু বিশিষ্ট ভূতত্ত্ববিজ্ঞানী জ্যাঁ-এটিয়েন গুয়েটার্ড । ১৭৬৩ থেকে ল্যাভয়সিয়ের গুয়েটার্ডের সহকারী হিসাবে, ফ্রান্সের প্রথম ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। জিপসাম ও প্ল্যাস্টার অব প্যারিস সম্পর্কে গবেষণা করেন; ১৭৬৫ সালে ফ্রান্সের বিখ্যাত অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস এর সভায় তা পাঠ করেন। এরপর ১৭৬৮ সালে তিনি এর সদস্যপদে নির্বাচিত হন।
এই সময়ে তিনি মায়ের উত্তরাধিকারী হিসাবে প্রভূত ধনসম্পত্তি লাভ করেন; যার সাহায্যে তিনি ফার্মে জেনেরাল নামে এক সংস্থার অংশীদারীত্ব গ্রহণ করেন। পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য নিজের ডিজাইন করা দামি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি তৈরি করতে, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই অর্থ তাঁর সহায়ক হয়েছিল। রাজকীয় সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ফার্মে জেনেরালের সদস্যদের প্রতিবছর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ রাজকীয় সরকারের কাছে জমা দিতে হত; বিনিময়ে তাঁরা ট্যাক্স কালেক্টর হিসাবে জনসাধারণের কাছ থেকে তামাক ও লবণের জন্য কর আদায় করতে পারতেন। অনেকটা আমাদের দেশের জমিদারদের মত। কর আদায়কারীর কাজ ল্যাভয়সিয়ের খুব মনোযোগ দিয়ে করতেন। অধিকাংশ ট্যাক্স আদায়কারীর বিরুদ্ধে সাধারণ অভিযোগ ছিল যে, তাঁরা বেশী বেশী কর আদায় করতেন, কখনো সখনো জোরজুলুমও করতেন। ল্যাভয়সিয়েরের বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ না থাকলেও, ট্যাক্স আদায়কারী মাত্রই জুলুমকারী এমন ধারণা ছিলই। ফার্মে জেনেরালের অংশীদারিত্ব, ফরাসী বিপ্লবের সময় তাঁর জীবনে চরম বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
১৭৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, ফার্মে জেনেরালের বরিষ্ঠ এক সদস্যের কন্যা, মেরী অ্যান পিয়েরেট পলজের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ল্যাভয়সিয়ের। বিবাহের সময় মেরীর বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। অত্যন্ত উৎসাহী ও বুদ্ধিমতী। রসায়নবিজ্ঞান বা বিজ্ঞানশিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও, ল্যাভয়সিয়েরের তত্ত্বাবধানে তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে ল্যাভয়সিয়েরের সহকারী হিসাবে গড়ে তোলেন। যে যুগে মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ ছিল অত্যন্ত সীমিত, সেই সময়ে নিজের অধ্যবসায় ও আন্তরিকতায় মেরী বিজ্ঞান জগতে নিজের জায়গা তৈরী করে নিয়েছিলেন। ভাল ইংরেজী জানতেন বলে, ইংলন্ডের বিজ্ঞানীদের গবেষণাপত্র ল্যাভয়সিয়েরের জন্য ইংরেজি থেকে ফরাসীতে অনুবাদ করে দিতেন। পরীক্ষনিরীক্ষা নথিবদ্ধ করতেন, প্রকাশনার আগে পরীক্ষায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির স্কেচ প্রস্তুত করে দিতেন ইত্যাদি।
ফরাসী রাজতন্ত্রের শেষদিকে ও ফরাসি বিপ্লবের প্রথমদিকে, ল্যাভয়সিয়ের অ্যাকাডেমি দ্য সায়েন্সেস ও বিভিন্ন সরকারী দপ্তরের প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করেছেন। ১৭৭৫ থেকে ১৭৯২, তিনি ছিলেন ফরাসি গানপাউডার (বারুদ) অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অন্যতম কমিশনার। তিনি তাঁর বাসস্থান ও পরীক্ষাগার এখানে স্থানান্তর করেন। এখানে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে সহকারী গবেষকদের নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতেন, নানা আলোচনা ও বিতর্ক চলত। বহু বিশিষ্ট মানুষজন এখানে তাঁর সঙ্গে দেখাসাক্ষাত ও আলোচনার জন্য আসতেন। এই সময়ে তিনি ফ্রান্সকে গানপাউডার বিষয়ে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলেন। কৃষিজ পণ্য উৎপাদনবৃদ্ধির লক্ষ্যে বহু পরীক্ষানিরীক্ষা চালান। ফ্রান্সে সেসময় খাদ্যশস্যের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। আর্থিক ও ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা সম্পর্কে বহু পরামর্শ প্রদান করেন। ওজন ও পরিমাপ বিষয়ে কমিশনার হিসাবে মেট্রিক পদ্ধতি চালু করার পথ প্রশস্ত করেছিলেন।
গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মত, সেসময়কার বহু ন্যচারাল ফিলোসফার মনে করতেন, সমস্ত পদার্থের প্রাথমিক উপাদান মাত্র চারটি : মৃত্তিকা(আর্থ), বায়ু, অগ্নি ও জল। মনে করা হত, এদেরকে কয়েকটি ভৌতধর্মের সাহায্যে চিহ্নিত করা যায়। মৃত্তিকা ও জল সঙ্কুচিত করা যায় না; বায়ুকে সঙ্কুচিত ও প্রসারিত দুরকমই করা যায়; অগ্নিকে বন্দী করা বা পরিমাপ করা যায় না। ১৭২০ সালে ব্রিটেনের পাদ্রী স্টিফেন হেলস দেখান যে, তরল বা কঠিন পদার্থে বায়ু আবদ্ধ হলে, বায়ুমন্ডলের বায়ু তার স্থিতিস্থাপকতা (ইলাস্টিসিটি) হারায়। হেল-এর পরীক্ষা ছিল বায়ু ও বিভিন্ন গ্যাসের পরীক্ষানিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের প্রথম ধাপ।
চূণাপাথরকে (ক্যালসিয়াম কার্বনেট) উত্তপ্ত করে চূণ (ক্যালসিয়াম অক্সাইড) পাওয়া যায়। আবার চূণে জল দিলে, তা হিসহিস শব্দ করে কলিচূণে (ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সাইডে) পরিণত হয়। জল শোষিত হয়; তাপও উৎপন্ন হয়। কলিচূণ খোলা বাতাসে রেখে দিলে তার উপর ধীরে ধীরে এক শক্ত আবরণ পড়ে, দীর্ঘসময় রেখে দিলে শক্ত হয়ে যায়। কলিচূণের ভিতর দিয়ে বায়ু প্রবাহিত করলে বা বায়ুর সংস্পর্শে রাখলে, তা পাথরের মত শক্ত পদার্থে (ক্যালসিয়াম কার্বনেট) পরিণত হয়। এই ধর্ম প্রয়োগ করে বহুকাল ধরে ইমারত তৈরি হত। ১৭৫০ সালে জোসেফ ব্ল্যাক পরীক্ষার সাহায্যে দেখালেন যে, এই ধরণের বিক্রিয়ায় আবদ্ধ বায়ু, সাধারণ বায়ুর থেকে আলাদা। ব্লেক জানতে চাইলেন, কলিচূণ বাতাসে রেখে দিলে ধীরে ধীরে তার ক্ষারত্ব প্রশমিত হয় কেন? কলিচূণে শোষিত বায়ুকে তিনি বললেন ' ফিক্সড এয়ার '। আমরা একে এখন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বলে জানি। লোহাতে মরিচা পড়ার কারণও আবদ্ধ বায়ু, যাকে আমরা অক্সিজেন (এবং জলীয় বাষ্প) বলে জানি। এরকম বিভিন্ন পদার্থে আবদ্ধ বায়ুকে চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়ে যায়, যাদের রাসায়নিক ধর্ম সাধারণ বায়ু থেকে আলাদা। বায়ু যে পদার্থের প্রাথমিক উপাদান নয়, তা এইভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্রান্সের অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস এর সদস্যপদ লাভের পর, গবেষণার বিষয়বস্তু হিসাবে ল্যাভয়সিয়ের বায়ুকে কেন্দ্র করে দহন (কমবাশন) শ্বসন (রেসপিরেশন) ও ক্যালসিনেশন (যেমন, মরিচা পড়ে লোহা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাওয়া) প্রক্রিয়াকে গবেষণার বিষয়বস্তু হিসাবে গ্রহণ করেন।
ইউরোপে রেনেশাঁর প্রভাবে পুরাতন ধ্যানধারণাকে নতুনভাবে যাচাই করে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছিল। ল্যাভয়সিয়ের বিশ্বাস করতেন, রাসায়নিক বিক্রিয়ায় কোনো পদার্থের ধ্বংস বা সৃষ্টি হয় না; কেবলমাত্র রূপান্তর ঘটে। বিক্রিয়ার আগে ও পরে পদার্থের মোট ভর অপরিবর্তিত থাকে। তাঁর এই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত ও সর্বজনগ্রাহ্য করতে গেলে প্রমাণ চাই। এজন্য তিনি জোর দিয়েছিলেন বিক্রিয়ার আগে ও পরে ওজন করার উপর। নিজের ডিজাইন করা যন্ত্রের দ্বারা তিনি নিজে ও, তাঁর সহকারীরা এজন্য পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে রাসায়নিক বিক্রিয়ার আগে ও পরে, বিক্রিয়ায় অংশ নেওয়া সমস্ত উপাদানের বহু ওজন নথিভুক্ত করেন। দেখা যায়, তাঁর অনুমান সঠিক। প্রতিষ্ঠিত হয় রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ভর সংরক্ষণ তত্ত্ব।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে জার্মান বিজ্ঞানী গিওর্গ স্টাহল, দহন শ্বসন ও ক্যালসিনেশন সম্পর্কে তাঁর তত্ত্ব বিবৃত করেন। তাঁর তত্ত্ব ফ্লজিস্টন তত্ত্ব নামে পরিচিত। এতে বলা হয়, প্রত্যেক দাহ্য পদার্থের ভিতর আছে ফ্লজিস্টন। গ্রীক ভাষায় ফ্লজিস্টন শব্দের অর্থ দাহ্য পদার্থ। বাতাসে কাঠকয়লা পোড়ালে তার ওজন কমে যায়। স্টাহল এই অবশেষের নাম দিয়েছিলেন 'ক্যালক্স'। স্টাহলের ব্যাখ্যা, দহনের ফলে কাঠকয়লা থেকে ফ্লজিস্টন মুক্ত হয়ে বাতাসে মেশে, তাই দহনের পর পড়ে থাকা কাঠকয়লার ছাইয়ের ওজন, কাঠকয়লার ওজনের চেয়ে কম হয়। স্বভাবতই ধরে নেওয়া যায়, কোনো পদার্থের ক্ষেত্রে দহনের পর পড়ে থাকা অবশেষ কালক্সের ওজন, যার ক্ষেত্রে যত কম কম, তার ভিতর ফ্লজিস্টনের পরিমাণ তত বেশী। ধাতুর ক্যালক্সকে (ধাতুর অক্সাইডকে) কাঠকয়লার সঙ্গে মিশিয়ে উচ্চতাপে দহনক্রিয়া ঘটালে, মূল ধাতুটিকে পাওয়া যায়। স্টাহলের ব্যখ্যা, কাঠকয়লায় থাকা ফ্লজিস্টন ক্যালক্সের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে এমন ঘটেছে। এই যুক্তিতে যেসব ধাতুর মধ্যে ফ্লজিস্টন আছে বলে মনে করা হত, তাদেরকেও দাহ্য পদার্থের শ্রেণিভূক্ত কর হল। আবার ধাতুকে শুধুমাত্র বায়ুতে রেখে তীব্রতাপে উত্তপ্ত করে যে ক্যালক্স পাওয়া গেল, তার ওজন হল ধাতুটিকে পোড়ানোর আগের ওজনের চেয়ে বেশি। ব্যাখ্যা দেওয়া হল, দহনের ফলে ধাতু থেকে নেগেটিভ ওজনের ফ্লজিস্টন বার হয়ে যাওয়ার ফলে, ক্যালক্সের ওজন ধাতুর চেয়ে বেশি হয়েছে। ল্যাভয়সিয়ের দেখেছিলেন,বাতাসে ফসফরাস ও সালফারের দহনের ফলে ক্যালক্সের ওজন বৃদ্ধি হয়। লেড-এর ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। কিন্তু লেড ক্যালক্স উত্তপ্ত করে তা থেকে তিনি অনেকটা পরিমাণ বায়ু সংগ্রহ করতে পারলেন। এই ঘটনা ফ্লজিস্টন তত্ত্বের যথার্থতা সম্পর্কে ল্যাভয়সিয়েরকে সন্দিহান করে তুলেছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন, ফ্লজিস্টন নয়, দহনে বায়ুর ভূমিকাই আসল। কিন্তু তখন বায়ুর উপাদান সঠিকভাবে জানা ছিল না।
১৭৬৬ সালে ইংল্যান্ডের হেনরি ক্যাভেন্ডিস বায়ু থেকে একটি গ্যাস পৃথক করতে সমর্থ হন; খুব সহজে জ্বলতো এই নতুন গ্যাস। তাই তিনি এই নতুন গ্যাসের নাম দেন, 'দাহ্য বায়ু' (ইনফ্লেমেবল এয়ার)। এরপর ইংল্যান্ডের জোসেফ প্রিস্টলি দেখলেন, সাধারণ বায়ু ও দাহ্য বায়ু আবদ্ধ পাত্রে একসঙ্গে রেখে দহন করলে, পাত্রের দেওয়ালে অল্প পরিমাণে শিশিরবিন্দুর মত জল জমা হয়। ক্যাভেন্ডিস ফ্লজিস্টন তত্ত্বের সাহায্যে এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, পাত্রের মধ্যে আবদ্ধ দুধরণের বায়ুতে, দহন শুরুর আগে থেকে দুটিতেই জল ছিল। ১৭৭৪ সালে প্রিস্টলি প্যারিসে ল্যাভয়সিয়েরের সঙ্গে সাক্ষাত করেন ও বিস্তারিত আলোচনা করেন। খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই সাক্ষাত। পারদ উত্তপ্ত করে যে লাল রঙের ক্যলক্স পেয়েছিলেন, তাকে উত্তপ্ত করার ফলে নির্গত গ্যাস সংগ্রহ করেছিলেন তিনি; নাম দিয়েছিলেন ' বিশুদ্ধ বায়ু ' (পিওর এয়ার)। প্রিস্টলি দেখেছিলেন , তাঁর পিওর এয়ারের মধ্যে একটি মোমবাতি দারুণভাবে আরো উজ্জ্বল শিখায় জ্বলছে, একটি ইঁদুর আরো চনমনে ভাবে বেঁচে থাকছে। প্রিস্টলি ফ্লজিস্টন তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা দিলেন যে, পারদ ক্যালক্সকে উত্তপ্ত করে যে বায়ু তিনি সংগ্রহ করেছেন, তা ফ্লজিস্টনমুক্ত বায়ু (ডিফ্লজিসটিকেটেড এয়ার)। তাই এরকম হচ্ছে।
ক্যাভেন্ডিস বা প্রিস্টলির এইসব ব্যাখ্যা মন:পুত হল না ল্যাভয়সিয়েরের কাছে। ততদিনে তিনি বুঝতে পারছিলেন ফ্লজিস্টন নয়, বায়ুর ভূমিকাই আসল। প্যারিসে তাঁর পরীক্ষাগারে তিনি পারদের ক্যালক্স নিয়ে, প্রিস্টলির পরীক্ষা নতুনভাবে করে দেখলেন। বিভিন্ন ধাতুর ক্যালক্স নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলল। তিনি সিদ্ধান্তে এলেন, সাধারণ বায়ুর দুইধরনের উপাদান আছে: প্রথমটি দহনপ্রক্রিয়ায় ধাতুর সঙ্গে যুক্ত হয়; দ্বিতীয়টি দহন বা শ্বসনে সহায়তা করে না। ১৭৭৭ সালের মধ্যে ল্যাভয়সিয়ের তাঁর নতুন তত্ত্ব প্রকাশের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। তিনি ঘোষণা করলেন, দহন হল এমন এক রাসায়নিক বিক্রিয়া, যাতে ধাতু বা জৈব পদার্থ সাধারণ বায়ুর সেই অংশের সঙ্গে যুক্ত হয়, যা সুস্পষ্টভাবে শ্বসনযোগ্য ( এমিনেন্টলি রেসপিরেবল)। এর দুবছর পর প্যারিসের রয়্যাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসকে জানালেন যে, অধিকাংশ অ্যাসিডের মধ্যে, তিনি এই শ্বসনযোগ্য বায়ুর অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছেন। ল্যাভয়সিয়ের এর নাম দেন ' অক্সিজেন '; গ্রীক ভাষায় যার অর্থ অ্যাসিড জেনারেটর। ১৭৮৩ সালে স্টাহলের ফ্লজিস্টন তত্ত্বকে ল্যাভয়সিয়ের বলে দিলেন, এক কাল্পনিক সত্ত্বা, যা ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ আচার ও ধর্ম পরিবর্তন করে। তিনি বললেন, রসায়নবিজ্ঞান থেকে কাল্পনিক অযৌক্তিক ও পরষ্পর বিরোধী মত পরিহার করে, সুষ্পষ্ট চিন্তার পথ অনুসরণ করতে হবে। অনুমান ও কল্পনা (হাইপোথিসিস) থেকে, পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষালব্ধ তথ্যকে আলাদা করে দেখতে হবে। তাঁর দহনতত্ত্বে ( থিয়েরী অব কম্বাশন) তিনি অক্সিজেনের কেন্দ্রীয় ভূমিকার কথা জানালেন। ১৭৮৩ সালে তিনি বায়ুর সঙ্গে অক্সিজেনের বিক্রিয়া ঘটিয়ে বিশুদ্ধ জল উৎপাদন করলেন। এর থেকে তিনি সঠিকভাবে সিদ্ধান্তে এলেন যে, জল মৌলিক পদার্থ নয়; বরং জল হল অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন সংযুক্ত হয়ে উৎপন্ন, এক যৌগিক পদার্থ।
রবার্ট বয়েলের মৌলিক পদার্থের ধারণাকে গ্রহণ করেছিলেন ল্যাভয়সিয়ের। তিনি মৌলিক পদার্থের নাম অপরিবর্তিত রেখে দিলেও, যৌগিক পদার্থের নামের ক্ষেত্রে এমন পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা বললেন, যাতে যৌগিক পদার্থের রাসায়নিক উপাদানগুলির নামও বুঝতে পারা যায়। ল্যাভয়সিয়ের রসায়নবিজ্ঞানে তাঁর নতুন পদ্ধতির কথা তাঁর ' টেইতে এলিমেন্টেয়ার দ্য কেমি' (এলিমেন্টস অব কেমিস্ট্রি) পুস্তকে লিপিবদ্ধ করেন। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তাপের প্রভাব, গাসের ধর্ম, অ্যাসিড ও ক্ষারের সঙ্গে বিক্রিয়ায় লবণ (সল্ট) উৎপাদন, রাসায়নিক পরীক্ষায় ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রের বিবরণ, ইত্যাদি এই পুস্তকে বিবৃত করেছেন। খুব সুস্পষ্টভাবে ভর সংরক্ষণ সূত্র বিবৃত করেছেন, “ প্রত্যেক বিক্রিয়ার আগে ও বিক্রিয়ার পরে পদার্থের ভর সমান থাকে “। এই বইতে তখনকার জানা পদার্থের সরল উপাদান তথা বর্তমান কালের মৌলিক পদার্থের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। এই বই প্রকাশ হয়েছিল ১৭৮৯ সালে; ফরাসী বিপ্লবের উত্তাল সময়ের মধ্যে, সে-বছরই বাস্তিল দূর্গের পতন ঘটেছিল।
ল্যাভয়সিয়ের ফরাসী বিপ্লবের সমর্থক ছিলেন। নরমপন্থী। বিপ্লবজনিত সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিজ্ঞান গবেষণা ব্যহত করছে, একথা তিনি মুক্তকন্ঠে বারবার ঘোষণা করেছেন। বিবৃতি দিয়েছেন। ১৭৯৪ সালের জানুয়ারিতে ল্যাভয়সিয়েরসহ ফার্মে জেনেরালের সকল সদস্যের নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি হয়। তাঁরা সকলেই গ্রেপ্তার হন। ৮মে ১৭৯৪ রেভলিউশনারি ট্রাইবুনালে তাঁদের বিচার হয়। বিচারে প্রত্যেকেই দোষী সাব্যস্ত হন। ল্যাভয়সিয়েরসহ সকলেরই মৃত্যদন্ড দেওয়া। হয়। সেদিনই, ৮মে ১৭৯৩, সকলের সঙ্গে গিলোটিনে ল্যাভয়সিয়েরের শিরশ্ছেদ করা হয়।
References :
1) Antoine Laurent Lavoisier The Chemical Revolution - Landmark
American Chemical Society.
https://www.acs.org/education/whatischemistry/landarks/lavoisier.html
2) Antoine Lavoisier
Written by Arthur L Donovan
Encyclopedia Britannica
https://www.britannica.com/biography/Antoine-Lavoisier
3) Anyoine Lavoisier (1743 – 1794)
ScienceDirect.
https://www.sciencedirect.com/topics/mathematics/lavoisier