সূচিতে ফিরুন

পাই(π) এর কথা

লেখক - বিকাশ মণ্ডল
img

যদি প্রশ্ন করা হয়, সংখ্যার দুনিয়ায় সর্বাধিক চিত্তাকর্ষক ও জনপ্রিয় সংখ্যা কোনটি? তবে নির্দ্বিধায় এর উত্তর হবে, পাই(π)। এর কারণ স্বরূপ বলা যায়, অসংখ্য, অগণিত সংখ্যার মাঝে পাই হল এমন একটি সংখ্যা যা হাজার হাজার বছর ধরে গণিতবিদ ও বিজ্ঞানীদের বিমোহিত করেছে। শুধু গণিতজ্ঞ বা বিজ্ঞানীরাই নয়, রহস্যময়ী পাই এর ফাঁদে পা দিয়েছে অনেকেই। কেউ পাই- এর নামে সিনেমা বানিয়েছে, কেউ পাই- এর জীবনী লিখেছে, কেউবা আবার পাই- এর মান দশমিক বিন্দুর পর লক্ষাধিক ঘর পর্যন্ত মুখস্থ করেছে। আজকাল তো পাই- এর জন্মদিন পালন হচ্ছে। এককথায়, পাই -কে নিয়ে মর্ত্যের মানুষের পাগলামির যেন শেষ নেই। 

কিন্তু পাই সংখ্যাটিই বা কী এবং কেনই বা তার এতো কদর? পাই হল বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত। ছোট, বড়, মাঝারি - যেকোনো ধরণের বৃত্তের ক্ষেত্রে এই দুটি জিনিসের অনুপাত সর্বদা একই হবে। অর্থাৎ এটি একটি ধ্রুবক সংখ্যা। একে তাই বৃত্তীয় ধ্রুবক বলা হতো। পরে যখন বিশ্বের অন্যতম সেরা গণিতজ্ঞ আর্কিমিডিস পাই -এর মান নির্ণয় করার চেষ্টা করলেন, তখন থেকে এর নতুন নাম হল আর্কিমিডিসের ধ্রুবক। এরপর ষোড়শ শতাব্দীতে ডাচ গণিতজ্ঞ, যিনি তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় পাই –এর মান নির্ণয় করতে ব্যয় করেছিলেন, সেই লুডলফ ভ্যান কলেন(Ludolph Van Ceulen) এর নামানুসারে কেউ কেউ একে লুডলফাইন সংখ্যা(Ludolphine Number) বলতে শুরু করলেন। কাজেই, সহজেই অনুমেয় যে পাই হয়ে ওঠার আগে সংখ্যাটি একাধিক নামে পরিচিত ছিল। অবশেষে, 1706 সালে ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ উইলিয়াম জোন্স তাঁর লেখা “A New Introduction to the Mathematics” বইতে সংখ্যাটির নাম রাখেন ‘পাই’; যা কিনা গ্রীক বর্ণমালার ষোড়শ বর্ণ। কিন্তু গ্রীক বর্ণমালায় আরও তো বর্ণ ছিল, তাহলে তিনি 'π' বর্ণটিকে পছন্দ করলেন কেন? আসলে ‘পরিধি’ শব্দটির গ্রীক প্রতিশব্দ হল ‘পেরিফেরি (Periphery)’ যার প্রথম বর্ণ হল ‘P’ যা আবার গ্রীক বর্ণ 'π' এর সমতুল্য। সেই থেকে অদ্যাবধি সংখ্যাটি পাই নামেই অধিক পরিচিতি লাভ করে।

 

এ তো গেল পাই সংখ্যাটির ‘পাই’ হয়ে ওঠার গল্প। তবে যেটা আজও গণিতজ্ঞদের কাছে চ্যালেঞ্জিং মনে হয়, তা হল পাই -এর সঠিক মান খুঁজে বের করা। আর এরজন্য প্রধান ও সবচেয়ে সুস্পষ্ট পন্থা হল একটি নিখুঁত বৃত্ত অঙ্কন করে তার পরিধি ও ব্যাস নির্ণয় করা। বস্তুত, প্রাচীন গণিতজ্ঞরা এই পদ্ধতিতে পাই - এর মান নির্ণয় করার চেষ্টা করতেন আর এভাবেই তাঁরা প্রথম বুঝতে পারেন যে প্রতিটি বৃত্তের মধ্যে একটি ধ্রুবক অনুপাত লুকিয়ে আছে, যা একটি অমূলদ সংখ্যা। এই পদ্ধতির সাফল্য নির্ভর করে বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের দৈর্ঘ্য কতটা নির্ভুলভাবে পরিমাপ কর হয় তার ওপর। কারণ ফিতে ব্যবহার করে পাই –এর দশ বা তার বেশি দশমিক স্থান পর্যন্ত মান নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব।

সম্ভবত, সেইজন্য গ্রীক গণিতবিদ আর্কিমিডিস সর্বপ্রথম জ্যামিতিক পদ্ধতিতে পাই –এর আনুমানিক মান নির্ণয়ের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি একটি বৃত্তের ভেতরে সুষম ষড়ভুজ এঁকে তার বাইরে আর একটি সুষম ষড়ভুজ আঁকলেন। এরপর তিনি অন্তঃষড়ভুজ ও বহিঃষড়ভুজ উভয়েরই পরিসীমা বা পরিধি এবং কেন্দ্র থেকে বাহুর দূরত্ব অর্থাৎ ব্যাস নির্ণয় করলেন। এবার প্রতিক্ষেত্রে পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত নির্ণয় করলেন। স্পষ্টত, পাই –এর মান হবে এই দুই মানের মধ্যবর্তী। এইভাবে বহুভুজের বাহু সংখ্যা যত বাড়তে থাকবে পাই –এর মান তত নির্ভুল হবে।

 

আর্কিমিডিস এই পদ্ধতিতে সর্বাধিক 96 টি বাহু বিশিষ্ট বহুভুজ ব্যবহার করেছিলেন এবং এইভাবে তিনি পাই –এর যে মান পেয়েছিলেন তা 223/71 ও 22/7 এর মধ্যবর্তী।

এখন, 223/71≈3.1408 এবং 22/7≈3.1428

তাই বলা যায়, আর্কিমিডিস পাই –এর যে মান পেয়েছিলেন তা দুই দশমিক স্থান পর্যন্ত সঠিক।

 

আর্কিমিডিসের প্রায় 600 বছর পর তাঁরই পদ্ধতি অনুসরণ করে চাইনিজ গণিতজ্ঞ জু চংঝি(Zu Chongzhi) পাই –এর মান পেয়েছিলেন 355/113 ; যা ছয় দশমিক স্থান পর্যন্ত সঠিক। এর জন্য তাঁকে বৃত্তের ভেতর সম্ভবত 24, 576 টি বাহু বিশিষ্ট একটি সুষম বহুভুজ আঁকতে হয়েছিল।

এরপর যাঁর কথা বলতে হয়, তিনি হলেন লুডলফ ভ্যান কলেন, যিনি 20 দশমিক স্থান পর্যন্ত পাই –এর সঠিক মান নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং এই মান তাঁর লেখা “ On the Circle” বইতে 1596 সালে প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তীকালে পাই –এর এই মানকে তিনি 35 দশমিক স্থান পর্যন্ত সঠিকভাবে বিস্তৃত করেছিলেন। এই দুঃসাধ্য সাধন করতে তিনি বৃত্তের ভেতরে 2^64 টি বাহু বিশিষ্ট সুষম বহুভুজ এঁকেছিলেন এবং পাই –এর সঠিক মান গণনায় জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছিলেন।

পাই –এর মান নির্ণয়ের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় পদ্ধতি হল অসীম শ্রেণির(Infinite series) ব্যবহার। এদের মধ্যে সবচেয়ে সুপরিচিত ও সুন্দর শ্রেণিটির নাম হল গ্রেগরি-লাইবনিজ শ্রেণি(Gregory-Leibniz series)।

π/4=1-1/3+1/5-1/7+1/9-…

শ্রেণিটির সবচেয়ে বড় অসুবিধা হল পাই -এর মান পেতে এর বহুসংখ্যক পদকে একসঙ্গে যোগ করতে হয়। তিন শতাধিক পদ একসঙ্গে যোগ করলে তবেই পাই -এর দুই দশমিক স্থান পর্যন্ত সঠিক মান পাওয়া যায়।

দ্বিতীয় বিখ্যাত শ্রেণিটি হল নীলকণ্ঠ-শ্রেণি(NilaKantha series)।

π=3+4/2X3X4-4/4X5X6+4/6X7X8-4/8X9X10+⋯

পঞ্চদশ শতাব্দীতে ভারতীয় গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী নীলকণ্ঠ সোমায়াজী(Nilakantha Somayaji) এই শ্রেণিটি ব্যবহার করে পাই –এর আনুমানিক মান নির্ণয় করেছিলেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজ গণিতজ্ঞ উইলিয়াম শ্যাঙ্কস(William Shanks) পাই –এর মান নির্ণয় করার জন্য অপর এক ইংরেজ গণিতজ্ঞ জন মেচিনের ফর্মুলা ব্যবহার করেছিলেন।

π=16 tan^(-1)⁡〖1/5-4 tan^(-1)⁡〖1/239〗 〗

প্রায় 15 বছর ধরে নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে 1873 সালে শ্যাঙ্কস দাবি করেন যে তিনি 707 দশমিক স্থান পর্যন্ত পাই –এর সঠিক মান পেয়েছেন। তাঁর এই দাবি তাঁকে সখের গণিতবিদ হিসাবে বেশ জনপ্রিয় করে তুলেছিল এবং দীর্ঘদিন গণিতজ্ঞমহল তাঁর এই দাবিকে অভ্রান্ত বলে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ভুল ধরা পড়ল 1944 সালে এসে। মেকানিক্যাল ডেস্ক ক্যাল্কুলেটর ব্যবহার করে গণিতজ্ঞ ডি. এফ. ফারগুসন(D F Ferguson) দেখালেন যে শ্যাঙ্কস পাই –এর যে মান পেয়েছিলেন তা দশমিকের পর 527 ঘর পর্যন্ত সঠিক। তা সত্ত্বেও শ্যাঙ্কসের আবিষ্কারকে কোন অংশে ছোট করা যায় না। কারণ কম্পিউটারের আগমন ঘটার পূর্বে পাই –এর মান নির্ণয় করাটা ছিল ভীষণ পরিশ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ।

আগেই বলেছি পাই কে নিয়ে মানুষের পাগলামির শেষ নেই। এবার সেই পাগলামির সপক্ষে কয়েকটি উদাহরণ দিলে মন্দ হয় না; তাই না?

মহাপুরুষদের জন্মদিন পালন (যেমন, জাতীয় যুব দিবস, জাতীয় গণিত দিবস) কিংবা কোন একটি বিশেষ দিনের উদযাপন(যেমন, স্বাধীনতা দিবস, বিশ্ব পরিবেশ দিবস) নতুন কিছু নয়। কিন্তু যখন শুনি অসীম, অনন্ত সংখ্যার মাঝে কোন একটি সংখ্যাকে বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে প্রতি বছর স্মরণ করা হচ্ছে তখন সত্যিই বড় অবাক লাগে। শুরুটা হয়েছিল আমেরিকান পদার্থবিদ ল্যারি শ(Larry Shaw) এর উদ্যোগে। 1988 সালের 14ই মার্চ তিনিই সর্বপ্রথম পাই দিবস(Pi Day) পালন করেন। কিন্তু প্রশ্ন হল- 14ই মার্চ কেন? কেন বছরের অন্য কোন দিন নয়? কারণ 14ই মার্চ কে আমেরিকান পদ্ধতিতে লিখলে হয় 3.14 ; যা দুই দশমিক স্থান পর্যন্ত পাই কে সূচীত করে। কাকতালীয়ভাবে এই দিনটি আবার বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের জন্মদিন। এ যেন সোনায় সোহাগা! বলা বাহুল্য, সেই থেকে প্রতি বছর 14ই মার্চ ‘পাই দিবস’ হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। শুধু তাই নয়, 2009 সালে আমেরিকার হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস 14ই মার্চ কে ‘জাতীয় পাই দিবস’ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

 

পাই কে কেন্দ্র করে ‘পিলিশ(Pi-lish)’ নামক ভাষার জন্ম অপর এক বিস্ময় উদ্রেককারী ঘটনা। এই ভাষায় আস্ত একটি বইও লিখে ফেলেছেন মাইকেল কিথ(Michael Keith) নামক এক গণিতজ্ঞ। বইটির নাম- “নট এ ওয়েক(Not A Wake)” এবং বইটির প্রথম প্রকাশকাল 2010 সাল। ‘পিলিশ(Pi-lish)’ ভাষা আসলে কী এবং কীভাবে এই ভাষায় বই লেখা সম্ভব তা বুঝতে হলে একই সঙ্গে পাই সংখ্যাটিকে এবং মাইকেল কিথের লেখা বইটির প্রথম লাইনটিকে লক্ষ করতে হবে। 3.1415926535→ Now I fall, a tired suburbian in liquid under the trees,

8979323846 →Drifting alongside forests simmering red in the twilight over Europe.

স্পষ্টত, পাই সংখ্যায় পরপর যে অঙ্ক গুলো রয়েছে তাদের সমান সংখ্যক বর্ণ থাকতে হবে পরপর লেখা শব্দগুলিতে। তাহলে যেকোনো ভাষাই পরিণত হবে পিলিশ ভাষায়। এইভাবে মাইকেল কিথ তাঁর বইতে পাই এর প্রথম 10,000 টি অঙ্ক ব্যবহার করেছিলেন।অর্থাৎ, কিথের বইতে মোট শব্দের সংখ্যা 10,000 টি। বলাবাহুল্য, পিলিশ হল মানব মস্তিষ্ক প্রসূত কাল্পনিক একটি ভাষা।

পরিশেষে বলা যায় যে, পাই হল সত্যিকারের আশ্চর্যজনক একটি সংখ্যা, যা সারা বিশ্বের গণিতবিদ ও গণিত প্রেমিক মানুষদের মন জয় করেছে।

সূচিপত্র