সূচিতে ফিরুন

সময় মুক্ত অঞ্চলে

লেখক - ডঃ জয়শ্রী পট্টনায়ক
img

‘সময়’ বিজ্ঞানের এক ধ্রুব সত্য।

কিন্তু সময় টা কি চলছে ঠিক মত?

প্রতীক্ষার ক্ষণে

সময় টা যেন থমকে থাকে

অ—ন—ন্ত-কা-ল-------- !

দরকারি কাজের আগে

ঘড়ির কাঁটা যেন ছুটতে থাকে

দেরী করে দেওয়ার জন্য---------!

সুখের সোনালী মুহূর্ত

নিমেষেই হয় অদৃশ্য

আর দুঃখের ঘনঘোর নিশা

কিছুতে----ই কাটেনা!

তাই ব্যাকুল হয়ে করি প্রশ্ন

সময় তুমি কি নিরপেক্ষ?

সময় বলে ,

আপন গতিতে মত্ত আমি এক আপেক্ষিক তত্ত্ব।

সময় কে চোখে দেখা যায় না। তাকে কোন বেড়াজালে আটকে রাখা যায় না। অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ ---------- এই তিন বিন্দুতে সময়ের খেলা। অতীত থেকে শুরু করে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যতের দিকে তার দৌড়। তার গতিপথ ক্যালেন্ডার আর ঘড়ির কাঁটায় মেপে নিতে হয়। ঘুম থেকে উঠে ঘড়ি ধরে দৈনন্দিন জীবন যাত্রা। ক্যালেন্ডার ধরে দিন মাস বছরের হিসাব। মানুষ সময়ের কাছে বাঁধা। অথচ, ২০১৯ সালে নরওয়ের সোমারয় নামে একটি ছোট্ট দ্বীপ দেশের সরকারের কাছে আবদার করে বসলো যে এই অঞ্চলটিকে বিশ্বের প্রথম টাইম –ফ্রী-জোন বলে যেন ঘোষণা করা হয়। চারিদিকে হৈচৈ । বিশ্বের তাবড় তাবড় সংবাদ পত্র গুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল।

রব তুলল, কেন কেন?

ব্যাবসায়িরা বলে উঠলো, -------গেল গেল! ব্যাবসা লাটে উঠল।

শিক্ষাবিদ দের মাথায় হাত, তাহলে কি পড়াশুনো বন্ধ হবে?

সোমারয় অধিবাসীদের অকাট্য যুক্তি, আমরা সময়ের ধার ধারি না। এখানে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ সময় সূর্য ওঠে না। আমরা অন্ধকারে থাকি। আবার মে মাস থেকে জুলাই পর্যন্ত ৬৯ দিন একটানা আলো। সূর্য অস্ত যায় না। বাঁধা ধরা দিন রাত বলে কিছু নেই। তাই খিদে পেলে খাই, ঘুম পেলে ঘুমাই, আবার যখন ইচ্ছা কাজ করি।

বাস্তবিক অর্থে কথাটা সত্য, বিজ্ঞজনেদের মন্তব্য।

-কেন কেন?

-এই দ্বীপের মানুষ মাছ ধরে জীবন কাটায়। অধিবাসী সংখ্যা ৪০০ পার হয় নি। বাদ বাকি সবাই পর্যটক । এখানে ঘড়ি কোন মহাকাজ টা করবে শুনি? ৬৯ দিন সূর্যাস্ত না হওয়ায় সময় কে তোয়াক্কা না করে যখন খুশী পার্টি করা, সাঁতার কাটা, পাহাড়ে চড়া ইত্যাদি নানান কাজ করা যায় এবং এখানে তা হয়ে থাকে। মাঝরাতে সমুদ্রে স্নান, রাতভর বীচে গা এলিয়ে রৌদ্রে পড়ে থাকা ইত্যাদি এখানে জলভাত।

-যখন খুশী তখন কাজ করলেও আমরা কাজটা মন দিয়ে করি এবং মৎস্য শিল্পের জন্য নরওয়ে তে পরিচিতি রয়েছে আমাদের, স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সদম্ভ উক্তি।

কেউ কেউ বলে এটা টুরিস্ট আকর্ষণ করার নতুন ফন্দি, বাস্তবে তা মোটেই সম্ভব নয়।

যাকগে, সব শুনে টুরিস্টরা আনন্দে নেচে উঠলো। সোমারয় এর প্রাকৃতিক দৃশ্য অতুলনীয়। সাদা বালির বিচ, পাহাড়ের আনাচে কানাচে সমুদ্র খাঁড়ি, বন জঙ্গল, নানান ধরণের পশুপাখি মাছ ইত্যাদি সব মিলিয়ে প্রকৃতিপ্রেমী দের স্বর্গস্থান। তার উপর বছরের কয়েক মাস একটানা দিন বা রাত্রি। মে মাস থেকে জুলাই একটানা দিনে মাঝ রাতের সূর্য (midnight sun) এক অভূতপূর্ব উপলব্ধি । আর নভেম্বর থেকে জানুয়ারি একটানা রাত্রির মাঝে মাঝে মায়াবী নর্দান লাইট এর আভা, আহা! যেন স্বর্গপুরী! এমনিতেই সারাটা বছর ভ্রমণ বিলাসীদের আনাগোনা নরওয়ের অর্থনীতি কে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করছে । বছরের কয়েক টা মাস ২৪X৭ ঘণ্টা একটানা দিন ও রাত্রি তে ঘড়ির কাঁটা বন্ধ থাকলে (টাইম –ফ্রী-জোন) তো কথাই নেই। সোমারয় আইল্যান্ড এ এসে হাত ঘড়ি টাকে বাক্সবন্দী করে মিশে যাও প্রকৃতির সাথে যতক্ষণ না হোটেল মেয়াদ শেষের ঘণ্টা বাজায়।

এহেন পরিস্থিতি তে প্রসিদ্ধ ভ্রমন সংস্থা থমাস কুক, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নর্দান লাইট ট্যুরে ভারতবর্ষ থেকে একদল পর্যটক নিয়ে উঠলো সোমারয় দ্বীপের অতি বিখ্যাত আর্কটিক হোটেল এ। এখানে এখন প্রবল শীত। ছোট্ট শহরটা বরফে ঢাকা। দিন রাত সবই অন্ধকারে, একটানা রাত্রি, চলবে সেই জানুয়ারী পর্যন্ত। হোটেলের প্রত্যেক টি ঘরের বিশাল বিশাল কাঁচের জানালা ও সম্পূর্ণ কাঁচের দেওয়াল ঘেরা বসার ঘরে ফায়ার প্লেস এর উষ্ণতায় কফি তে চুমুক দিতে দিতে রাতে নর্দান লাইট দেখা যাবে বলে জানা গেছে । শীতের রাতে এই অলৌকিক দৃশ্য দেখতে খোলা আকাশের নিচে বসে থাকতে হবে না শুনে ভারতীয় পর্যটকরা আহ্লাদে আটখানা। সাধারণত সন্ধ্যে পাঁচটার পর থেকে রাত তিনটা পর্যন্ত যেকোনো সময়ে দেখা যায় অরোরা ( aurora borealis) বা নর্দান লাইট । কখনও তা থেমে থেমে আবার কখনও একটানা ১৫/৩০ মিনিট ধরে চলে। সবাই উত্তেজনায় টগবগ করছে নতুন উপলব্ধির। রাত প্রায় নয়টা। খাওয়া দাওয়া সেরে অতিথিরা বসার ঘরে হাজির। এখন শুধু অপেক্ষা সেই মহাক্ষণের। ফায়ার প্লেস ঘিরে বসে থাকা সবার মনে নানান প্রশ্ন। থমাস কুক এর প্রতিনিধি অক্লান্ত ভাবে হাসিমুখে তার উত্তর দিছেন।

- নর্দান লাইট এর উৎপত্তি নিয়ে কিছু বলবেন কি?

-নিশ্চয়ই! অরোরা (aurora borealis) বা নর্দান লাইট (northern light) রাতে দেখা দিলেও তার সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং সূর্য। সূর্য আলো ও উষ্ণতা ছাড়াও নানান ধরনের এনার্জি এবং আহিত ক্ষুদ্র কণা (charged small particle) সর্বদা মহাকাশে ছুড়তে থাকে। তার কিছু অংশ আমাদের গ্রহের দিকে ও আসে। পৃথিবীর চারিদিকে বর্ম হিসাবে থাকা চুম্বক শক্তি (magnetic field) ক্ষতিকর এনার্জি এবং আহিত ক্ষুদ্র কণা থেকে আমাদের গ্রহ কে অনবরত রক্ষা করে আসছে যা আমরা বুঝতে পারি না।

কিন্তু সৌর ঝড় (solar wind) উঠলে এইধরনের এনার্জি এবং আহিত ক্ষুদ্র কণা বিপুল বেগে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে। আমাদের গ্রহের চৌম্বকীয় বর্ম তার অনেকটা প্রতিহত করে কিন্তু কিছু অংশ পৃথিবীর আবহাওয়া মণ্ডলে ঢুকে যায়। পৃথিবীর চৌম্বকীয় শক্তি তখন তাদের নর্থ ও সাউথ পোল এর দিকে ঠেলে দেয়। এই প্রক্রিয়ায় সূর্য থেকে আসা কণা গুলোর সাথে আমাদের বায়ু মণ্ডলে থাকা গ্যাসের কণার জোর ধাক্কা লাগে এবং তার ফলে তাদের গতি শক্তি (kinetic energy) দৃশ্যমান আলোয় (visible light energy) পরিবর্তিত হয়ে যায়।

-সেই আলোর রঙ কি হয়?

যখন বায়ু মণ্ডলে অক্সিজেন এর সাথে ধাক্কা লাগে তখন লাল বা গোলাপি রঙ দেখা যায় আবার যখন নাইট্রোজেন এর সাথে ধাক্কা খায় তখন সবুজ বা নীল রঙ এর আভা বের হয়।

-তাহলে সাউথ আর নর্থ দুই পোলেই এই লাইট দেখা যায়?

-হুম। সাউথ পোলে এই আলো কে বলা হয় সাদার্ন লাইট (southern light/ aurora australis) ও নর্থ পোলে বলা হয় নর্দান লাইট।

-আমরা নরওয়ে এলাম কেন নর্দান লাইট দেখতে?

-কারণ এখানকার ট্রমসো (Tromso) শহর নর্দান লাইট দেখার জন্য জগৎখ্যাত। সোমারয় দ্বীপ ট্রমসো শহরের একটি অংশ। এত সুন্দর আলোর বর্ণছটা ইউরোপ এর অন্য স্থান, আমেরিকা বা কানাডায় সচরাচর দেখা যায় না।

-ভারতবর্ষে কি এই ধরণের আলো দেখা যায়?

-হুম, লাদাখ এর লেহ অঞ্চলে কশ্চিৎ কখনও দেখা গেছে।

কথোপকথন চলতে চলতে ঘরের আলো ধীরে ধীরে মৃদু হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কাঁচের বসার ঘর রঙিন আভায় ভরে গেল। সবাই বাক্যহারা। নিকষ কালো আকাশ উজ্জ্বল লাল নীল সবুজে উদ্ভাসিত হতে হতে অনির্বচনীয় আলোর নৃত্য শুরু হল আকাশে। আর তাতে তাল মিলিয়ে প্রকৃতি যেন শূন্যে নানান রঙে ছবি আঁকতে শুরু করলো। কখনও তা একগুচ্ছ রঙিন রিবনের মত বরফঢাকা ভূখণ্ডের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে আবার কখনও রঙিন আলোর ঝর্ণাধারা মুহূর্তে শুভ্র ধরিত্রী কে বর্ণময় করে তুলছে। সব মিলিয়ে রং আর আলোর এক অবিমিশ্র দৃশ্য যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।