
১
ছুটে চলা অপূর্ব এক নেশা। এই ছোটা যদি হয় অন্ধকার, নীরব মহাশূন্যের ভেতর দিয়ে, তার আমেজ আরোই আলাদা ধরণের সুন্দর। অবশ্য সৌন্দর্য আমি মাপি যুক্তির কাঠামো দিয়ে, কার্যকারিতা দিয়ে। সৌন্দর্য আসলে কোনও কাজের নয়, দরকারি নয়। কেউ ছুটছে মানে সে ভাল আছে, সক্ষম আছে। তার জীবন ভাল না থাকলেও চালু রয়েছে। চালু না-থাকলে যে-কোনও বস্তু তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।
অন্ধকার মহাকাশের মধ্য দিয়ে ধেয়ে যাচ্ছি আমরা নির্দিষ্ট অভিমুখে। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু আচমকা খেয়াল করলাম এক অসম্ভব গণ্ডগোল। এই রকম সমস্যা হওয়ার কথা নয়, উচিতও নয়। কিন্তু হচ্ছে। আজব এক সমস্যা।
আমাদের সুপার-কম্পিউটার টাব্বু নির্দেশের উত্তর দিচ্ছে না। পালন তো করছে-ই না। কথাও বলছে না কোনও। একেবারে চুপ। অথচ কোনও রকম ম্যালফাংশনের সঙ্কেত নেই মেশিনে। খুবই অদ্ভুত ব্যাপার। আমি কিছু ক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলাম কন্ট্রোল বোর্ডের দিকে। কালার-কোডেড বহু সুইচ ও হাতল মজুত এই বোর্ডে। ব্যবহারের দরকার পড়ে না। এমারজেন্সি হিসেবেই রাখা। কিন্তু ব্যবহার করতে জানি। জানি, এই যানের সঙ্গে জড়িত সমস্ত কিছু।
এই যানের সঙ্গে আমার চলাফেরা বহু বছরের। এর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমার চোখের সামনে আপগ্রেডেড হয়েছে আস্তে-আস্তে। এখন, আজকের সময়ে, যানের গতি, দিক ইত্যাদি ব্যাপারে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাতে হয় না। তবু ঘামাই। বহু বছরের অভ্যাস ছাড়া মুশকিল। আর সেই অভ্যাসের জন্যই টাব্বুর গণ্ডগোলটা আমি লক্ষ করেছি। বাকি তিন জন কেউ বুঝতে পারেনি।
টাব্বু অন্য দিকে যাচ্ছে। দিক-পরিবর্তনটা খুব সামান্য। খুব অল্প কোণে বদলটা ঘটছে বলেই স্বচ্ছ জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালে ফারাকটা টের পাওয়া যায়নি। যে-দিকে আমাদের যাওয়ার কথা নয়, সে-দিকে আমরা চলেছি। এটা অসম্ভব। নির্ধারিত গতিপথের বাইরে টাব্বু একচুলও নড়াচড়া করতে পারে না। কোনও বিপদ হয়ে থাকলে, যার জন্য বাধ্য হয়ে এই দিক পরিবর্তন করতে হয়েছে, সেটা আমাকে আগে জানানোর কথা টাব্বুর। আমার অনুমতি লাগবে না, কিন্তু জানাতে হবেই। জানায়নি। এখন সে কথাও বলছে না। বারবার ডেকেও কোনও সাড়া মেলেনি। অথচ সে বিকল হয়নি, তা নিশ্চিতভাবেই জানি। প্রোগ্রাম অনুযায়ী, মেইন কম্পিউটারের দশ শতাংশের বেশি খারাপ হলেই যানের নিয়ন্ত্রণ আমি নিয়ে নিতে পারব। তার আগে নয়। তার আগে আমি চাইলেও নিয়ন্ত্রণ পাব না। টাব্বুর উপর বিশ্বাস এতটাই, ভরসা এতটাই। আর সেটা সঠিকও। তার কারণ, মানুষ ভুল করতে পারে। যন্ত্র চাইলেও ভুল করতে পারবে না। তাই যন্ত্রের উপরে দায়িত্ব দিয়ে রাখাটাই স্বাভাবিক। দশ-শতাংশ কেন, এক শতাংশই খারাপ হয়নি। তাই আমার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ হাতে পাওয়া, যাকে অফিশিয়ালি বলে, ম্যানুয়াল ওভাররাইড, তার ক্ষমতা পাওয়া সম্ভব না।
কী ঘটেছে, কিছু জানতে পারিনি। বুঝতে পারিনি। ভেবে বার করতে পারিনি। টাব্বুকে তার পর থেকে যতবার ডেকেছি, কোনও সাড়া নেই। অথচ সে যে অকার্যকর হয়নি, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
ঠায় দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকলাম। যানের বাকিদের কারও সঙ্গে আমি আলোচনা করিনি এই বিষয়ে। তাদের জানাইওনি কিছু। তারা ভয় পেয়ে যেতে পারে। তাতে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। ভয়, আতঙ্ক, দুঃখ প্রভৃতি সব ধরণের আবেগগুলো কোনও কাজে আসে না মানুষের।
তা হলে কী করা যায় এখন? এখন কিছু যদি করার থেকে একমাত্র অপাল-ই করতে পারবে। সে আমাদের এই দলের চিফ ইঞ্জিনিয়ার। টাব্বুর কী হয়েছে তা খুঁজে বের করা কিংবা কোনও ফাঁকফোকর দিয়ে যানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া দরকার। পারলে ও-ই পারবে। আমি আপাতত কোনও উপায় দেখতে পাচ্ছি না।
কিন্তু এই অপাল গেছে উন্মাদ হয়ে।
হ্যাঁ, উন্মাদ। পাগল রীতিমত। মানুষ পাগল হল, তার পর যন্ত্র? ব্যাপারটা সন্দেহজনক। এ সন্দেহও মনে উঁকি দিচ্ছে, অপালই কিছু করে বসেনি তো! নাহ! তা-ই বা সে করবে কেমন করে? তাকে আমরা বাধ্য হয়েছি আটকে রাখতে। একেবারে বাধ্য হয়েই ওকে গুদামঘরের পাশের ঘরে আটকেছি। নিয়মিত খাবার, জল পাঠিয়ে দিই। ওখানে বাথরুম নেই। বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও নেই। সমস্যা হবে অনেকটা। কিন্তু উপায় নেই আমাদের কাছে। আমি বাদে অপালকে সমেত এই যানের চারজন সদস্যের অলিখিত দায়িত্ব আমার। তাদের কোনও বিপদ হতে দিতে পারি না। ওর পাগলামো আমাদের একেবারে আনকোরা কোনও বিপদের মুখে ফেলে দিতে পারত।
বুঝতে পারলাম না অপাল বসুর ঠিক কী হল। মেনে নিচ্ছি, মানব মস্তিস্ক এক আজব চিজ। বিগড়ে যেতে চাইলে সে কোনও কিছুর তোয়াক্কা করবে না। তবুও ব্যাপারটা হজম করা শক্ত। যানে ওঠার আগে দীর্ঘ সময় ধরে প্রত্যেকের শারীরিক ও মানসিক পরীক্ষা চলে। নির্দিষ্ট মাপকাঠি না পেরোলে তাকে অনুমতি দেওয়া হয় না। সব পরীক্ষাতেই অপাল বসু সাফল্যের সঙ্গে পাস করেছিল। তা-ও কেন হল এমনটা? কান্ডটা বিরল। এই মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন হিসেবে কখনও এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি আমার। হয়ও না। দীর্ঘ সতেরো বছর ধরে বিভিন্ন নক্ষত্রমন্ডলীতে পাড়ি দিচ্ছি আমি। দামি, দরকারি খনিজ সংগ্রহ করা প্রধান কাজ। মানব-কলোনি স্থাপন করা যাবে কিনা, সেসব তথ্যও সংগ্রহ করা হয়। এই তথ্যের বিলিয়ন ডলার মার্কেট আছে পৃথিবীতে। আমি এই কাজে পারদর্শী, তাই দাম আছে আমারও।
মহাকাশচারিরা সহজে পাগল হয় না। প্রচুর সাইকোলজিকাল পরীক্ষার পরেই ছাড়পত্র মেলে অভিযানে অংশ নেওয়ার। আমাকেও প্রতিবার পরীক্ষায় বসতে হয়। কেন পাগল হয়ে গেল অপাল বসু? বারবার সে বলছিল যান পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। চিৎকার করছিল। ছোটাছুটি করছিল। লাফ দিচ্ছিল বারবার। লাফাচ্ছিল কেন ঐভাবে? ওর মতো মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার আমাদের দেশে নেই। ওর এটা প্রথম সফর। বোধ হয় শেষও। পৃথিবীতে ফিরে চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে নিশ্চয়ই। তবে মহাকাশ-যাত্রার সুযোগ ওকে আর দেওয়া হবে না।
বেশ খানিকক্ষণ নিজের সমস্ত অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে চেষ্টা করলাম টাব্বুর সঙ্গে যোগাযোগের। কোনও সাফল্য নেই। আমাদের মহাকাশযান ছুটে চলেছে অজানা এক রাস্তা ধরে। যে রাস্তার অন্তিম গন্তব্য জানা নেই। কী করব এখন?
নাহ! অপালকে ডাকতে হবে। তিনদিন ধরে সে বদ্ধ হয়ে আছে ঘরটায়। দেখা যাক কেমন আছে। প্রথমেই বার করব না। কথা বলে দেখি একটু। চেষ্টা তো করতেই হবে। আর যখন অন্য কোনও পথ দেখতে পাচ্ছি না।
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। তার পর রওনা হলাম গুদামঘরের দিকে। দরজার বাইরে এসে থামলাম। বিশেষ সংকর ধাতুর শক্ত পাল্লা। ফাঁক নেই কোথাও। কান পেতে রইলাম কিছু ক্ষণ। না, ভেতর থেকে কোনও শব্দ আসছে না। নড়াচড়ার শব্দও নেই। আমি জোরে ডাকলাম, “অপাল।”
এক মিনিট পর জবাব এল, “হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন। বলুন।”
সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের মতো কণ্ঠস্বর। তা হলে কি ওর পাগলামোটা সাময়িক ছিল। সেরে গেছে? ভাল ব্যাপার।
“কয়েকটা প্রশ্ন করছি। উত্তর দেবে?”
“হ্যাঁ।”
“পাই-এর মান কত?”
“তিন দশমিক এক চার পাঁচ।” জবাবটা এল মুহূর্তের মধ্যে।
আরও কিছু প্রশ্ন করলাম ওকে। কয়েকটা লজিক্যাল হেঁয়ালি জিজ্ঞেস করলাম। কয়েকটা শক্ত গুণ। সবেরই সঠিক উত্তর দিতে দেরি করল না অপাল।
মাথার গণ্ডগোল সেরে গেছে কি? নিশ্চিন্ত হব? নিশ্চিন্ত না-হওয়ার যুক্তি নেই। তা হলে সাময়িক কোনও নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছিল হয়তো। দরজা খুললাম। ভেতরটা বদ্ধ, বাজে গন্ধে ভরা। অপাল বেরিয়ে এল হালকা পায়ে। মুখেচোখে ক্লান্তি ও অনিদ্রা-র ছাপ।
“ঠিক আছো এখন?” জানতে চাইলাম।
আমার সঙ্গে এগোতে-এগোতে হাসল অপাল, “ঠিক তো ছিলাম-ই।”
দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি, “না। ছিলে না। হাবিজাবি বকছিলে। তুমি বলছিলে, যান ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পৃথিবীতে।”
“জানি।” দীর্ঘশ্বাস ফেলল অপাল, “এখনও তাই বলছি। বারবার তাই বলব।”
সতর্ক হলাম। একটু বেগরবাই দেখলেই অপালকে আবার বন্দী করতে হবে। বললাম, “অন্তত আগের মতো অবুঝ আচরণ করছ না।”
“করছি না। কারণ, ওরকম করে লাভ নেই, বুঝতে পেরেছি। বুঝতে সময় লেগেছে।”
আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। কনট্রোল-রুমের দিকে যাচ্ছি। অপাল মুখ নিচের দিকে রেখে হাঁটতে হাঁটতে শান্ত গলায় বলল, “ক্যাপ্টেন, আমি কখনই পাগল হইনি। আসলে ভয়ঙ্কর বিপদটা বুঝতে পেরে হুঁশ হারিয়ে ফেলেছিলাম তখন। এতটুকু দেরি হোক, সেটা সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই একটু ছেলেমানুষি করে ফেলেছি।”
“বিপদ! কী বিপদের কথা বলছ?” হুঁশিয়ার হয়ে জানতে চাইলাম।
হাসল অপাল। কিছু বলল না। মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকল।
“বলো!” তাড়া দিলাম, “কিসের বিপদ?”
“বলব। একটু পরে।” অপাল তাকাল আমার দিকে। “আপনি আমাকে বার করতেন না ঘর থেকে। করেছেন নেহাত বাধ্য হয়েই। করার কারণটা কী বলবেন?”
নিচু গলায় বললাম, “টাব্বু রেসপন্স করছে না। অন্য দিকে যাচ্ছে।”
ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে চাইল অপাল। ওর কপালে চিন্তার ভাঁজ, “অন্য দিকে? ম্যানুয়াল ওভাররাইড করা যাচ্ছে না?”
“না। দশ শতাংশের নিয়মটা তুমি জানো।”
ঘাড় হেলাল অপাল। ওর মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। বলল, “কিন্তু-”
“কী হয়েছে জানি না। সেই জন্যই তোমাকে...”
অপাল মলিন-মুখে হাসল, “চলুন। দেখি। যদিও আমার মনে হয় না-”
কথা অসমাপ্ত রাখল ও। জানতে চাইলাম, “কী মনে হয় না?”
ও জবাব দিল না।
২
অপাল স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সুইচ-বোর্ডের দিকে। ও ঘাঁটাঘাঁটি করে কিছুই বুঝতে পারেনি সমস্যাটা কোথায়। তার পর কিছু ক্ষণ দুই হাত অলসভাবে দু’দিকে ঝুলিয়ে হেঁটে বেড়াল খানিক। এখন চুপ করে চেয়ে আছে। বিরক্ত হয়ে গেলাম ওর হাবভাব দেখে। যুক্তিহীন কাজকর্ম দেখলেই আমি বিরক্ত হই।
“কী বুঝলে অপাল?” জিজ্ঞেস করলাম।
সাদা রঙের দেওয়ালের গায়ে হাত বোলাল অপাল। ঠোঁটের উপরে তর্জনী রেখে ফিসফিস করে বলল, "আস্তে কথা বলুন। দেওয়ালের কান আছে। মেঝেরও। কানগুলো অন্যরকম। অন্য গঠনের। কিন্তু আছে। লিখে কথা বললে ভাল হত। কিন্তু লেখার কোনও ব্যবস্থা নেই।"
“কান!” আলতো গলায় বললাম, "মহাশূন্যের মাঝখানে কে আড়ি পাতবে?"
"এটাই তো খুব বড় ভুল চিন্তা!”
“ভুল! কেন?”
অপাল প্রশ্নের জবাব দিল না। বলল, “আচ্ছা মিস্টার অর্জুন, আপনি কি জানেন, আমরা যার মধ্যে আছি এটা কোনও সাধারণ স্পেসসিপ নয়?"
"নয়ই তো!" অবশ্যই সাধারণ নয়। সতেরো বছর ধরে ভুলত্রুটি ছাড়া সার্ভিস দিয়ে যাওয়া সাধারণ ব্যাপারের মধ্যে পড়ে না।
অপাল বিস্ময় ও আশার চোখে তাকাল আমার দিকে। পরক্ষনেই মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল আগের মতো, "নয়। কারণটা যা ভাবছেন তা নয়। আসল কারণ, সতেরো বছর ধরে এটা নিছক কোনও মহাকাশযান ছিল না।'
ভুরু কুঁচকে তাকালাম ওর দিকে, "তা হলে?"
ও মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকাল। হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "আমি যন্ত্রের হৃৎস্পন্দন টের পাই ক্যাপ্টেন অর্জুন। পদার্থের শ্বাস শুনতে পাই। সলিড স্টেট ফিজিক্সে আমার নামে এতগুলো পেটেন্ট কেন?”
“প্রতিভা।”
“প্রতিভা? নাহ! প্রতিভা কী আমার জানা নেই। প্রতিভা বলে কিছু হয় আমি বিশ্বাস করি না।”
“তোমার বিশ্বাস করা-না-করায় বাস্তবটা বদলে যায় কি অপাল?”
“না। কিন্তু বাস্তব কী সেটাই যখন ধোঁয়াটে, তখন একমাত্র বিশ্বাসই পারে সেই ধোঁয়াকে কিছুটা হলেও সরিয়ে দৃশ্যকে পরিষ্কার করতে।”
“এখানে তা হলে যা ঘটছে তার পেছনের দৃশ্যটা কী? পরিষ্কার হয়েছে তোমার কাছে?”
অপাল মাথা নিচু করে রইল কিছু ক্ষণ। আপনমনে বিড়বিড় করল কীসব। শুনতে পেলাম না। মাঝখানে একবার হাসলও নিজে-নিজে। হাসিটা স্বাভাবিক খুশির বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হল না একেবারেই। কেমন যেন হতাশারই অভিব্যক্তি!
“বলো!” তাড়া দিলাম। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।
“হ্যাঁ। পরিষ্কার।”
“কী ঘটছে এখানে?”
“ক্যাপ্টেন, এই মহাকাশযান এক এলিয়েন।” অপাল বলল ধীর গলায়।
আমি খানিক ক্ষণ তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। মুখে-চোখে কোনও উন্মাদ-সূচক চিহ্ন নেই। শান্ত গলায় বললাম, “কী বললে, সেটা নিজে শুনতে পেয়েছ?”
“পেয়েছি। সেই জন্যই জানি, কথাটা কতটা অবিশ্বাস্য। কিন্তু দুঃখের কথা হল, এটা সত্যি।”
“মানে?”
“জানি, ব্যাপারটা মেনে নেওয়া…”
থামিয়ে দিলাম ওকে, “তুমি ইয়ার্কি মারছ? এখন ইয়ার্কির মতো পরিস্থিতি নয়। প্লিজ ডোন্ট।”
অপাল আস্তে-আস্তে মাথা নাড়ল। মুখে ঝুলে আছে করুণ একটা হাসি, “এটা একটা প্রাণ। ভীষণভাবে জীবিত একটা প্রাণী। এই কথা শোনা মাত্র অনেকগুলো প্রশ্ন এসে হাজির হবে আপনার মনে।”
“হ্যাঁ। প্রথম প্রশ্ন। তুমি যে পাগলামি করছ, তা কি নিজে টের পাচ্ছ?”
অপাল গুরুত্ব দিল না আমার বিদ্রুপে। আপনমনে বলল, “প্রাণীটা বুঝতে পারেনি, আমি একজন অদ্ভুত সংবেদনশীল মানুষ। ধাতুর একটা অদৃশ্য তাপ আছে বুঝলেন, যা মনে হয় কেবল আমিই বুঝতে পারি। পৃথিবীতে বোধ হয় আমি একাই বুঝতে পারি। কোনও যন্ত্রেও এই তাপ ধরা পড়ে না। বিভিন্ন যন্ত্র দিয়ে আমি পরীক্ষা করে দেখেছি, ধরা পড়ে না এই তাপের নিশান। ধাতুর মধ্যে ঘুরে বেড়ানো শক্তি প্রবাহ অনুভব করতে পারি আমি। ওরা আমার উত্তেজিত হওয়ার উপাদান। আনন্দ পাওয়ার উপকরণ। খেলার সামগ্রী। সেই তাপ আমি এর মধ্যে পাইনি। ধাতু হয়েও এটা ধাতু নয়। ধাতব প্রাণ বললে হয়ত সঠিকের কাছাকাছি যাওয়া যাবে।”
“ধাতব প্রাণ! পাগলের মতো কথা বলছ তুমি।” অপালকে বের করে আনা ভুল হয়েছে স্পষ্ট বুঝতে পারছি। কাজে মন দিতে হবে আমাকে। সমাধান করতে হবে টাব্বুর নীরবতার পেছনের সমস্যা। প্রত্যেক সেকেন্ড পেরোনোর সঙ্গে-সঙ্গে যান মূল গতিপথ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আমাদের জ্বালানী অফুরন্ত নয়, “ধাতব প্রাণ বলে কিছু হয় না।”
অপাল ঘাড় নাড়ল সম্মতি জানিয়ে, “আমাদের চেনা দুনিয়ায় হয় না। আমাদের জ্ঞান অনুযায়ী হয় না। কিন্তু হয়। যা বলছি, সেই কথাগুলো আমার কানেও ঢুকছে। এগুলো সত্যিই পাগলের প্রলাপ। ঠিকই। মানুষ পাগল হয়। যন্ত্র হয় না। কিন্ত সত্যি। এটাই সবথেকে ভয়ঙ্কর ব্যাপার। আমি সহ্য করতে পারছি না। আপনি জানেন, একটা ধাতুর বৈশিষ্ট্য কী?”
“সামান্য। অবশ্যই তোমার জ্ঞানের তুলনায় তা খুব কম। তুমি বলতে চাইছ এই মহাকাশযান একটা এলিয়েন! হলিউডি মুভির ট্রান্সফরমার টাইপ কিছু!”
“না। এটা ট্রান্সফর্মারদের মতো নিজেদের আকৃতি ইচ্ছামতো বদলাতে পারে না।”
“যাই হোক, তুমি যা বলছ তা নয় কোনোমতেই সম্ভব হতে পারে না, তর্কের খাতিরেও। এর কাঁচামাল পৃথিবীরই বস্তু। এর ধাতু পৃথিবীরই-এটাকে বানানোর সময় পর্যন্ত কারখানায় আমি ছিলাম।”
অপাল হাসল, “ছিলেন। কিন্তু ধাতুটা কোথেকে জোগাড় করা হয়েছিল, খোঁজ রাখেন কি?”
“পৃথিবীর বাইরে থেকে আনা হয়নি। কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই উল্টোপাল্টা জায়গা থেকে ধাতু এনে বানিয়ে ফেলা হয়েছে, তা কি তুমি বলতে পারো?”
“পরীক্ষা তো করা হয়েছেই। তা তো হবেই। পরীক্ষা যে করা হবে, তা কি এই বস্তু জানত না? জানত।” মুচকি হাসল অপাল।
“বলতে চাইছ, এই ধাতব প্রাণ আমাদের বিরুদ্ধে একরকম ষড়যন্ত্র করেছে!”
“ষড়যন্ত্র নয়। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে।” শান্ত গলায় বলতে থাকল অপাল, “তা অন্যায় নয়। বাঘ যখন হরিণ শিকার করে, তা যেমন অন্যায় নয়। আসলে আমিও জানি না এর ভাবনার ক্ষমতা কতটা। ভাবনা অনুযায়ী নিজেকে লুকিয়ে রাখতে কি পারেনি এ? পেরেছে। ধাতুর অভ্যন্তরীণ গঠন বিভিন্ন ধরণের হয়। স্ট্রাকচারের রকমফের অনেক। একটা প্রাণের, যেকোনো প্রাণের মূল উদেশ্য কী আপনি জানেন?”
“নিজেকে টিকিয়ে রাখা?”
“হ্যাঁ। যেনতেন প্রকারনে। এবং বংশবৃদ্ধি করা। নিজের প্রতিলিপি তৈরি না-করলে, না করতে পারলে, সেটা প্রাণ নয়। ধাতু বলতে আমরা কী বুঝি? যান্ত্রিক একটা বস্তু। ক্যাপ্টেন, আপনি নিজের দিকে কখনও তাকিয়েছেন?” অপাল করুণ মুখে হাসল, “নাহ! তাকিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। আপনি সতেরো বছর ধরে এই যানের কর্তা, তাই তো? সতেরো বছর আগের সঙ্গে, এখনকার নিজের, মনোজগতের তফাত লিখে দিতে পারবেন?”
“একটা মানুষ সতেরো বছরে অনেক বদলে যায়। চেহারার দিক থেকে সে-বদল ঘটুক চাই না ঘটুক, মন তো বদলাবেই।”
“আপনি শেষ কবে হেসেছেন ক্যাপ্টেন?”
ভাবলাম। মনে পড়ছে না।
“শেষ কবে কেঁদেছেন?”
আমি চুপ করে রইলাম।
অপাল অন্যমনস্ক স্বরে বলল, “ধাতু আমি চিনতে পারি। আমার থেকে ভাল কেউ চিনতে পারে না ধাতুকে। আমার এই উক্তিকে আপনি গর্ব ভাবুন বা মজা, কিচ্ছু এসে যায় না। ছোট্টবেলা থেকে ধাতু নিয়ে আমি প্যাশনেট। প্লাস্টিকের খেলনা ভাল লাগত না। বরং আমি নাড়াচাড়া করতাম উপহার পাওয়া রুপোর আংটি নিয়ে। জং ধরা লোহা কোথাও পেলে কুড়িয়ে আনতাম। জমাতাম। ঘাঁটতাম বারবার। ওগুলো পরে একদিন মা ফেলে দেয়। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। কিছু বলিনি। জানতাম, কাউকে বোঝাতে পারব না আমার আগ্রহ ও উৎসাহের কারণ।”
বুঝতে পারছিলাম না, লোকটা আমাকে নিজের ইতিহাস শোনাচ্ছে কেন? এখন ইতিহাস নিয়ে আড্ডা মারাটা আমাদের প্রায়োরিটি না।
অপাল দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “ক্যাপ্টেন, আপনি বুঝতে পারেননি। অবশ্য সেটা কখনই আপনার দোষ নয়। সিস্টেমের অংশ হয়ে সিস্টেমের ধীর, অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ধরতে পারা প্রায় অসম্ভব। তা-ও যদি সংশয় এসে হাজির হয়, তখন একমাত্র ধারাবাহিক পরীক্ষা চালালে ধরা গেলেও যেতে পারে।”
“কী বুঝতে পারিনি।”
“আপনি মানুষ নেই। এই স্পেসশিপের এলিয়েন বংশবৃদ্ধি শুরু করেছে আপনাকে দিয়ে। আপনাকে দিয়ে বোধ হয় না। আরও লোকজন আছে নিশ্চয়ই, যারা এর কাছাকাছি বা এর মধ্যে কমবেশি সময় কাটিয়েছে…আপনি ওর মতো হয়ে গেছেন বেশ কিছুটা। ধাতব প্রাণ হয়ে যাচ্ছেন ক্রমশ। পুরোপুরি হয়ে যাবেন। সম্পূর্ণ হতে হয়তো আরও সতেরো বছর লাগবে।” অপাল শান্ত চোখে তাকাল আমার দিকে। মায়াহীন চোখ।
বুঝতে পারলাম, অপাল সেরে ওঠেনি। এমনিতে সুস্থ, শান্ত লাগলেও মাথাটা ঠিক নেই বোঝাই যাচ্ছে। কড়া গলায় বললাম, “আমি ধাতু? ধাতু কথা বলতে পারে?”
“আমাদের চেনা কোনও ধাতু পারে না। যদিও এই না-পারা বলতে আমরা নিজেদের চেনা-জানা ভাব আদানপ্রদানের কথাই বলছি। ধাতুর থেকে ক্ষমতাশালী বস্তু আর কিছু নেই। ধাতুই আমাদের তৈরি করছে আকাশে উড়ান দিতে। গ্রহের বায়ুমণ্ডলের সীমাবদ্ধতা পেরোতে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে। তা হলে একবার ভেবে দেখুন, ধাতব প্রাণের সক্ষমতা কোন পর্যায়ের হতে পারে। ধাতু যদি ভাবতে সক্ষম হয়, সে কি বাকি সমস্ত প্রাণকে হারিয়ে দেবে না?”
“জানি। কিন্তু এসব দিয়ে কী করে প্রমাণ হচ্ছে আমি ধাতু?” একটু অধৈর্য হয়ে উঠলাম, “আমার মধ্যে ধাতুর বৈশিষ্ট্য আছে? আমার গা চকচকে?”
“নেই। কিন্তু আমি ধাতুর আবেশ টের পাচ্ছি আপনার দেহ থেকে। স্পন্দন টের পাচ্ছি ঠিক ধাতুর মতো। তা ছাড়া আপনার মধ্যে আবেগের চিহ্নমাত্র নেই। আপনি ভয়, দুঃখ আনন্দ কিছুই পান না। সম-মানের স্পন্দন আমি অনুভব করেছিলাম এই স্পেসশিপের সমস্ত অংশ থেকে। দেওয়াল, মেঝে... সব জায়গা থেকে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সাধারণ ধাতুর সঙ্গে প্রাণীজ ধাতুর তফাত থাকবেই। আর সেই তফাত আমি টের পেয়েছিলাম প্রবলভাবে। এ-ও বুঝতে পারছিলাম, যত ক্ষণ এর সংস্পর্শে থাকব, তত দেরি হয়ে যাবে নিজেকে এর মতো এক ধাতু হওয়া থেকে বাঁচাতে। তাই বারবার লাফাচ্ছিলাম।”
“থাক এসব কথা।” বেশি প্রশ্রয় দিলে সীমার বাইরে চলে যাবে এর বকবক। কড়া গলায় বললাম, “টাব্বুর গণ্ডগোল কি ধরতে পারলে?”
“না। তবে আন্দাজ করতে পারি।”
“কী?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল অপাল, “এলিয়েন বুঝতে পেরেছে যে, আমি ওকে ধরে ফেলেছি। তাই ঠিক করেছে ও আর পৃথিবীতে ফিরে যাবে না। টাব্বুকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেওয়া ওর কাছে কখনই বড় ব্যাপার ছিল না।”
“কোথায় যাচ্ছে?” অপাল বাজে বকছে। কিন্তু ওর বক্তব্যে সামান্য হলেও যুক্তি দেখতে পাচ্ছি।
“হতে পারে ওর নিজের গ্রহে। হতে পারে অন্য কোথাও। এর উদ্দেশ্য টের পাওয়া মুশকিল। সম্পূর্ণ আলাদা একটা প্রজাতির ভাবনা কী হতে পারে, তা বুঝে ওঠা কঠিন খুবই।”
“তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই তুমি ঠিক বলছ, ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনও পথ আছে?”
ঘাড় নাড়ল অপাল, “জানি না। যদি থাকেও, তা এখন খুঁজে বার করা যাবে কি? মনে হয় না। ভাষা বুঝে কথোপকথনের একটা সিস্টেম দাঁড় করানো ভীষণ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তা-ও যদি সেখানে দুই পক্ষ রাজি থাকে তথ্য বিনিময়ে। এক্ষেত্রে তেমন কোনও সম্ভাবনা বোধ হয় নেই।”
আচমকা স্পেসশিপটা একবার কেঁপে উঠল। কাঁপা নয়, নড়া। আমরা টলে পড়ে যেতে-যেতেও পাশের দেওয়াল ধরে সামলে নিলাম নিজেদের। তার পর আবার কাঁপল যান, কাঁপতে থাকল ছন্দ নিয়ে। আমরা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলাম।
অপাল বলল ফিসফিস করে, ব্যাকুল কন্ঠে, “ক্যাপ্টেন, আমার মনে হচ্ছে, এই কম্পনই বোধ হয় এর ভাষা। মহাবিশ্ব দাঁড়িয়েই আছে কম্পনের উপর। স্ট্রিং-এর বিভিন্ন রকম কম্পনে বিভিন্ন বস্তু সৃষ্টি হয়। বুঝতে পারছেন আপনি? আপনার বুঝতে পারার কথা। কারণ আপনি কিছুটা ওর মতো হয়ে আছেন। পারছেন বুঝতে? বলুন প্লিজ। সেটাই একমাত্র উপায় হতে পারে আমাদের রেহাই পাওয়ার-”
হ্যাঁ। আমি বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু এই বুঝতে পারাটা বিশ্বাস করতে চাইছিলাম না। বিশ্বাস করলে যে অপালের মতটাই স্বীকার করে নিতে হয়। আমার সতেরো বছরের সঙ্গী অদ্ভুত তালে কাঁপছে। আর এই কাঁপা-র মধ্যে লুকিয়ে থাকা অক্ষর, শব্দ, যতিচিহ্ন আমি শুনতে পাচ্ছি। অপাল পাচ্ছে না। আমি শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু এই শোনবার পেছনের ভয়াবহতাকে মেনে নিতে চাইছি না।
সঙ্গী বলছে, “মানুষ ভাল নয়। মানুষ অনুন্নত। তাই মানুষ হয়ে থেকে কোনও লাভ নেই।”