
মূল গল্প: Null-O
মূল রচনা: ফিলিপ কে ডিক
অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা শোওয়ার ঘর। তারই একটা দেয়ালে কান লাগিয়ে সেটার গায়ে সেঁটে দাঁড়িয়ে আছে লেমুয়েল। কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করছে সে। উত্তেজনায় তাঁর বুক ধক্ ধক্ করছে। বাইরে থেকে এক ঝলক হাওয়া ঘরের মধ্যে ঢুকে এল। জরির পর্দাগুলো সব দুলতে শুরু করেছে। ফ্যাকাশে হলদে আলো রাস্তার আলোক-স্তম্ভগুলো থেকে চুইয়ে এসে ছড়িয়ে পড়ল বিছানার উপরে, আলমারির বন্ধ পাল্লার উপরে, বই, খাতা, খেলনা আর আলনায় ঝোলানো জামা-কাপড়ের উপরে।
দুজন মানুষের কন্ঠস্বর ঠিক ওপাশের ঘরটা থেকে দেয়াল ভেদ করে ক্ষীন ভাবে তাঁর কানে আসছে। কারা যেন ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। “জিন, আমাদের একটা কিছু করতেই হবে,” একটা পুরুষ কন্ঠস্বর শোনা গেল।
ঠিক এরপরেই একটা দম আটকানো চাপা নিঃশ্বাসের শব্দ। কেউ যেন কষ্ট করে আঁতকে উঠতে গিয়েও গলা থেকে বেরিয়ে আসা শব্দ গিলে নিল। “র্যাল্ফ, দয়া করে ওকে আর মেরো না তুমি। তোমার মাথা কিন্তু তোমাকে ঠান্ডা রাখতেই হবে। আমি কিছুতেই আর ওকে মারধোর তোমাকে করতে দেব না।”
“আমিও ওকে আর মারধোর করতে চাইছি না।” ফিসফিস করে বলা সত্ত্বেও পুরুষ কণ্ঠটার স্বরে ফুটে উঠেছে নিদারুণ একটা যন্ত্রণার ছাপ। “ও কেন এরকম করে যাচ্ছে? কেনই বা ও অন্য সুস্থ স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতো বেসবল-টেসবল খেলে ভালো ছেলে হয়ে উঠতে পারছে না? কেন ওকে দোকানপাট পোড়াতে হবে? অসহায় প্রাণীদের ওপর নির্যাতন চালাতে হবে? কেন? কেন?”
“ও একটু অন্যরকম, র্যাল্ফ। আমাদের বোঝার চেষ্টা করতে হবে।”
“আমাদের বোধহয় কোনও ডাক্তারের কাছে ওকে নিয়ে যাওয়া দরকার,” তাঁর বাবা বলে উঠলেন। “হতেই তো পারে যে ওর কোথাও কোনও গ্ল্যান্ডের সমস্যা আছে।”
“ঐ বুড়ো ডক্টর গ্র্যাডির কথা বলছো নাকি তুমি? কিন্তু তুমি তো বলেছিলে যে ওনাকে দিয়ে আর কিস্যু হবে না—”
“না, ডক্টর গ্র্যাডি না। লেমুয়েল যেদিন ওনার এক্স-রে মেশিন আর অফিসের আসবাব সব ভাঙ্গচুর করল, তারপরেই উনি হাত তুলে নিয়েছেন। না, এবার যেখানে নিয়ে যাব সেটা আরও অনেক বড় ব্যাপার।” এরপর ছোট্ট একটা বিরতি। যা তাঁর টেনশন আরও বাড়িয়ে তুলল। “জিন, আমি ওকে পাহাড়ে নিয়ে যাচ্ছি।”
“ওহ্, র্যাল্ফ! প্লিজ না—”
“আমার সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে নিয়েছি।” কঠোর এক সংকল্পের ঘোষণা। কিন্তু কণ্ঠস্বরে যেন কোনও কোণঠাসা প্রাণীর জান্তব গরগরে কর্কশতা। “ওই মনোবিজ্ঞানীরা কিছু করতে পারলেও পারতে পারে। হয়তো ওনারাই ওকে সারিয়ে তুলতে পারবে। হয়তো পারবে না।”
“কিন্তু এটাও তো হতে পারে যে ওরা আর ওকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিল না। আর ... ওহ্, র্যাল্ফ, ওই তো আমাদের সব!”
“জানি,” র্যাল্ফ কর্কশ স্বরে বিড়বিড় করলেন। “আমিও জানি যে ওই আমাদের সবকিছু। কিন্তু আমি আমার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছি। যেদিন ওর নিজের শিক্ষককেই ছুরি মেরে ও জানালা দিয়ে লাফিয়ে পালিয়েছিল, সেদিনই আমি আমার মন ঠিক করে নিয়েছিলাম। লেমুয়েল পাহাড়ে যাচ্ছে।”
***
দিনটা ছিল উষ্ণ এবং সূর্যকরোজ্জ্বল। হাওয়ায় দুলতে থাকা গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে চোখে পড়ল কংক্রিট, ইস্পাত আর প্লাস্টিকের বিশাল সাদা রঙের হাসপাতালটা ঝকঝক করছে। র্যাল্ফ জর্গেনসন টুপিটা আঙুলের ফাঁকে পেঁচিয়ে অনিশ্চিতভাবে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছিলেন। জায়গাটার বিশালত্ব তাকে খানিকটা দমিয়ে দিয়েছে।
নিবিড় মনোযোগ দিয়ে লেমুয়েল কিছু শোনার চেষ্টা করছিল। এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার যে তাঁর বড় বড় কান দুটো সে নাড়াতে পারে। এখন সেই দুটো এদিক ওদিক নাড়িয়ে মনোযোগ নিবিষ্ট করতেই সে শুনতে পেল অসংখ্য কন্ঠস্বর তাঁর কানে ভেসে আসছে। সাগরের ঢেউয়ের মতো সেই সব কন্ঠস্বর আশপাশ থেকে তাঁর দিকে ছুটে আসছে। সে যেন ডুবে যাচ্ছে সেই শব্দ সমুদ্রে। আর সেই সব শব্দের ঢেউয়েরা ভেসে আসছে সামনের বিশাল চত্বরের মধ্যে থাকা অফিসগুলো থেকেই। সেগুলোর প্রত্যেকটা ঘর থেকে, অফিস বাড়িগুলোর প্রত্যেকটা তলা থেকে। শব্দ ঢেউয়েরা তাকে ক্রমশ উত্তেজিত করে তুলছিল।
তাদের দিকে এগিয়ে আসছিলেন ড. জেমস নর্থ। এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন তাদের দিকে। ভদ্রলোক লম্বা, সুদর্শন, বয়স সম্ভবত ত্রিশের আশেপাশে, বাদামী চুল আর চোখে শিংয়ের তৈরি কালো রঙের রিম-ওয়ালা চশমা। তাঁর পদক্ষেপ দৃপ্ত। লেমুয়েলের হাতটা যেভাবে বজ্রমুষ্ঠিতে চেপে ধরে সংক্ষিপ্ত করমর্দন করলেন তার মধ্যেও তাঁর মানসিক দৃঢ়তা আর আত্মবিশ্বাস ঝরে পড়ছিল। গমগমে গলায় বলে তিনি উঠলেন, “এদিকে চলে এসো।” র্যাল্ফ সঙ্গে সঙ্গে নিজেও অফিসের দিকে পা বাড়িয়ে ছিলেন, নর্থ মাথা নেড়ে তাকে বাধা দিলেন। “উঁহু, আপনি না। শুধু আপনার ছেলে। লেমুয়েল আর আমি এখন কিছুক্ষণ একান্তে গল্প করব।”
মনের মধ্যে একরাশ উত্তেজনা নিয়ে লেমুয়েল ড্. নর্থের পিছু পিছু তাঁর অফিসের দিকে রওনা হল। ঢোকার পরেই নর্থ তাড়াতাড়ি করে দরজাটা আটকে দিলেন তিন তিনটে ম্যাগনেটিক লক দিয়ে। “তুমি আমাকে জেমস বলেও ডাকতে পারো,” ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি হেসে বললেন তিনি। “আর আমি তোমাকে লেম বলে ডাকবো, কেমন? চলবে তো?”
“অবশ্যই,” লেমুয়েল উত্তর দিল খুব সাবধানে। এটা ঠিক যে লোকটার মধ্যে তেমন কোনও শত্রুতার লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু অনেক দিন আগে থেকেই সে সদা সতর্ক থাকাটা অভ্যাস করে নিয়েছে। এখানে তাকে থাকতেও হবে সাবধানে। এই সুন্দর দেখতে ডাক্তারটা বন্ধুর মতো ব্যবহার করছেন ঠিকই, কিন্তু এটাও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে লোকটা প্রচন্ড বুদ্ধিমান।
নর্থ একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। ছেলেটাকে বোঝার চেষ্টা করছেন তিনি। “রাস্তার বেওয়ারিশ কতকগলো বুড়ো ভবঘুরেকে তুমি ক’দিন বেঁধে ফেলে রেখেছিলে। তারপর কেটেকুটে ওদের ব্যবচ্ছেদও করেছিলে তুমি, তোমার মধ্যে তখন জেগে উঠেছিল মারাত্মক বৈজ্ঞানিক কৌতুহল, তাই তো?” বেশ কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে তিনি জিজ্ঞেস করলেন। “তুমি জানতে চেয়েছিলে—বাস্তব তথ্য, বই থেকে পড়ে অন্যের মতামত নয়। তুমি নিজেই দেখতে চেয়েছিলে যে মানুষের শরীরের ভেতরের গঠন ঠিক কী রকম, কীভাবে তাকে তৈরি করা হয়েছে।”
লেমুয়েলের অধীরতা আরও বেড়ে উঠল। “কিন্তু কেউ তো সেটা বুঝলই না।”
“না।” নর্থ মাথা নাড়লেন। “না। অন্য লোকেরা কেউ সেটা বুঝবে না। বুঝবে না কেন সেটা কি তুমি জানো?”
“মনে হয় আমি জানি।”
নর্থ উঠে পড়লেন। খানিকক্ষণ পায়চারি করলেন এদিক ওদিক ঘরটার মধ্যে। তারপর বললেন, “আমি কয়েকটা পরীক্ষা নেব তোমার। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে হবে আমাদের। আশা করি তুমি কিছু মনে করবে না, তাই না? দেখো, তোমার সম্পর্কে আরো অনেক কিছু জানতে হবে আমাদের দুজনকেই। যদিও এখন আমি অনেক কিছুই তোমার সম্পর্কে জানি। তবে লেম, কথা হচ্ছে যে আরও অনেক কিছু জানতে হবে। আমি এর মধ্যেই তোমার পুলিশ রিপোর্ট দেখে নিয়েছি। খবরের কাগজের ফাইলও দেখা হয়ে গেছে।” বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে গেলেন তিনি। ডেস্কের ড্রয়ার খুলে এক এক করে বের করলেন মিনেসোটা মাল্টিফ্যাসিক (*১), রোরশ্যাচ ব্লটস (*২), বেন্ডার গেস্টাল্ট (*৩), রাইনের এক গোছা ইএসপি কার্ড, (*৪), একটা ওইজা বোর্ড (*৫), এক জোড়া পাশা, একটা লেখার জন্য ম্যাজিক ট্যাবলেট, মোমের তৈরি একটা পুতুল যার পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত একদম নিখুঁত ভাবে তৈরি করা, আর একটা ছোট্ট সীসার টুকরো যাকে সোনা বানিয়ে(*৬) দেওয়া যায়।
“আপনি আমাকে দিয়ে কী করাতে চাইছেন?” অবাক লেমুয়েল জিজ্ঞেস করল।
“আমি তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব আর খেলার জন্য কয়েকটা জিনিস দেব। তারপর আমি তোমার উত্তর শুনব, তোমার প্রতিক্রিয়া দেখব, আর তার সঙ্গে সঙ্গে কিছু জিনিস নোট করব। কী হল? কী মনে হচ্ছে তোমার?”
লেমুয়েল ইতস্তত করছিল। তাঁর এরকম একজন বন্ধুর খুব প্রয়োজন ছিল—কিন্তু সে ভয়ও পাচ্ছে।
ডঃ নর্থ বুঝতে পারলেন। তিনি তাঁর হাত দুটো রাখলেন ছেলেটার কাঁধে। “তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। আমি ঐ বাচ্চাগুলোর মত নই যারা সেদিন সকালে তোমাকে মেরেছিল।”
লিমুয়েল কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে চোখ তুলে তাঁর দিকে তাকাল। “আপনি কি গোটা ব্যাপারটা জানেন? আমি দেখলাম ওদের খেলার নিয়মগুলো হচ্ছে পুরোপুরি ওদের মর্জিমাফিক। ওদের যা ইচ্ছে ওরা তাই করছে। স্বাভাবিকভাবেই ঐ পরিস্থিতিতে প্রাথমিক ভাবে যেটা করাটা আমার জন্যে সবচাইতে বাস্তবসম্মত ছিল সেটাই আমি করেছিলাম। যখন আমি ব্যাট করতে গেলাম তখন আমি সোজা পিচার আর ক্যাচারের মাথার উপর দিয়ে চালিয়ে দিলাম। আমি তো এই ঘটনার অনেক পরে বুঝতে পারলাম যে মানুষ মাত্রই তাদের সবার নীতিশাস্ত্র আর নৈতিকতা ঠিক সেই একই ধরণের—” বলতে বলতে সে হঠাৎ যেন ভয় পেয়ে গিয়ে থমকে গেল। তারপর একটু ইতস্তত করে বললে, “হয়তো আমি—”
ড. নর্থ ইতিমধ্যে তাঁর ডেস্কের পিছনে বসে রাইনের ইএসপি কার্ডের গোছাটা তুলে নিয়ে উল্টে পাল্টে দিয়ে সেগুলো এলোমেলো করতে শুরু করেছেন। “চিন্তা ক’রো না, লেম,” তিনি মৃদুস্বরে বললেন। “সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি যা বোঝার মোটামুটি বুঝে গেছি।”
পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর দুজনে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। একসময় ছ’টা বেজে গেল। বাইরে সূর্য ডুবতে শুরু করেছে। অবশেষে মুখ খুললেন ড. নর্থ।
“অবিশ্বাস্য। আমি নিজেও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারছি না। কিন্তু তোমার চিন্তা ভাবনা সবকিছুই সম্পূর্ণ যৌক্তিক। যা কিছু করেছ সব কিছুই একদম ন্যায্য করেছ। এই বয়সেই তুমি তোমার আন্তরমস্তিষ্কের যাবতীয় আবেগ সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে পেরে গিয়েছ। তোমার মন ইতিমধ্যেই নৈতিকতা আর সাংস্কৃতিক পক্ষপাত থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে গিয়েছে। তুমি সমস্ত রকমের সহমর্মিতা বোধহীন একজন বিশুদ্ধ অবিশ্বাসী। সম্পূর্ণ প্যারানয়েড একজন মানুষ। কোনও রকম দুঃখ, করুণা, সহানুভূতি কিংবা স্বাভাবিক মানবিক আবেগ অনুভব করতে তুমি সম্পূর্ণ অক্ষম।”
লেমুয়েল মাথা নাড়ল। “ঠিক ধরেছেন।”
ড. নর্থ বসেই ছিলেন। এবার পেছনে হেলান দিয়ে শরীরের ভার সম্পূর্ণ ছেড়ে দিলেন। বোঝা যাচ্ছে তিনি হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন। “আমার পক্ষেও এতটা হজম করা মুশকিল। বাপরে বাপ! এ তো বিশাল ব্যাপার। যা দেখছি তুমি একজন অত্যুত্তম মাত্রার যুক্তিবাদী মানুষ, প্রচলিত মূল্যবোধ সম্পর্কে তুমি সব রকম পক্ষপাতিত্ব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আর সেই তুমি ধরে নিয়েছ যে এই গোটা পৃথিবী তোমার বিরোধীতা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।”
“হ্যাঁ।”
“সেটা তো হবেই। কেননা যে মূহুর্তে সবাই জেনে যাবে যে তুমি মানুষের যাবতীয় কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করে ফেলেছ, জেনে ফেলেছ তাদের চরিত্রের প্রকৃত স্বরূপ, সেই মূহুর্তেই তারা সদলবলে তোমার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তারা অবশ্যই চেষ্টা করবে তোমাকে সমূলে ধ্বংস করে দিতে। করবেই।”
“কারণ আমি অন্য রকম। আলাদা।”
নর্থ ইতিমধ্যে নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছেন। যারা বিশুদ্ধ অবিশ্বাসী, যাদের মন নৈতিকতা আর সাংস্কৃতিক পক্ষপাত থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, মানুষ তাদের কখনোই বিশ্বাস করতে পারেনি। তাদের তারা প্যারানয়েড বলে দাগিয়ে দেয়। আর প্যারানয়েড হওয়াটাকে তারা একটা মানসিক রোগ হিসাবে প্রচার করে। কিন্তু তা তো সত্যি নয়! এমনও তো নয় যে তাদের মধ্যে বাস্তব বোধের কোনও অভাব আছে—বরং সম্পূর্ণ উল্টো, প্রকৃত অর্থে দেখতে গেলে যারা প্যারানয়েড তারাই সবচেয়ে বেশি বাস্তববাদী। আসলে সে একজন নিখুঁত অভিজ্ঞতাবাদী। তাঁর মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বা নীতি-সংস্কৃতির কোনও রকম ছুঁৎমার্গ থাকে না। যাকে প্যারানয়েড বলা হচ্ছে সেই আসলে যে কোনও জিনিসকে, সেটা বাস্তবে যেমন, তেমন ভাবেই দেখতে পায়; প্রকৃতপক্ষে সেই একমাত্র বিবেকবান মানুষ।”
“আমি মাইন ক্যাম্ফ-ও পড়ে দেখলাম,” লেমুয়েল শ্বাস নিয়ে বলে উঠল, “পড়ে যা বুঝলাম সেটা হচ্ছে এই যে এরকম শুধু আমি একা নই।” এই মূহূর্তে কথাটা যে শুধু সে মুখে বলল তাও নয়, সঙ্গে সঙ্গে সে বোধহয় মনে মনে নিঃশব্দে প্রার্থনা আর কৃতজ্ঞতাও জানালো: আমি একা নই। আমার মতো আরও আছে। আমরা অনেকেই আছি।
তাঁর মুখচোখের হাবভাব দেখেই ড. নর্থ বুঝতে পেরে গেলেন তাঁর মনের মধ্যে এখন ঠিক কী চলছে। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। মনে মনে শুধু উচ্চারণ করলেন, এই তো ভবিষ্যত, এই জলতরঙ্গ কে রোধ করবে? তারপর লেমকে বললেন, “দেখো, আমি তোমাদের এই তরঙ্গের কেউ নই, কিন্তু বোঝার চেষ্টাটুকু তো আমি করতেই পারি। আমি ভালো করেই জানি যে আমি একজন অত্যন্ত নগন্য মানুষ। আমার সীমাবদ্ধতা অনেক। মানসিক আবেগ আর সাংস্কৃতিক পক্ষপাত থেকে আমি সম্পূর্ণ মুক্ত নই। আমি তোমাদের একজন কখনোই যে হয়ে উঠতে পারব না সেটাও ঠিক, কিন্তু তোমাদের উপর আমার সহানুভূতি থাকবে চিরকাল . . .” থেমে গিয়ে মুখ তুলে তাকালেন তিনি। তাঁর চোখে মুখে এখন উৎসাহের উজ্জ্বলতা ঝকঝক করছে। তিনি বললেন, “আর হ্যাঁ, আরেকটা কথা—তোমাকে কিন্তু সাহায্য আমি করতেই পারি, আর সেটা যতটা পারি, আমি করব!”
***
পরের কয়েকটা দিন লেমুয়েলের জন্য ছিল উত্তেজনায় ভরপুর। তাঁর হেফাজত নিয়ে নেওয়ার যাবতীয় বন্দোবস্ত ডা. নর্থ করে ফেলতেই সেই ছেলে মহানন্দে শহরের শেষ প্রান্তে ডাক্তারের নিজের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে থাকা শুরু করে দিল। এখানে এখন তাঁর উপর পরিবারের আর কোনও চাপ রইল না; সে এবার যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে। ডা. নর্থ-ও আর সময় নষ্ট করলেন না। তিনি এবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন যাতে লেমুয়েল তাঁর মতোই অন্যান্য মিউট্যান্ট প্যারানয়েডদের খুঁজে বের করতে পারে।
এরকমই এক সন্ধ্যায় ডিনারের পর ডঃ নর্থ জিজ্ঞেস করলেন, “লেমুয়েল, তোমার কি মনে হয় তুমি আমাকে তোমার এই নাল-‘ও’ তত্ত্বটা বিশদে বুঝিয়ে দিতে পারবে? কোনো বস্তু বা কিছুই যে আসলে কিছুই না এই ধারণাটা ঠিকঠাক উপলব্ধি করা খুবই শক্ত।”
লেমুয়েল হাত ঘুরিয়ে গোটা অ্যাপার্টমেন্টের দিকে ইশারা করে। বলে, “এই যে এখানে এতরকম জিনিস আপনি আপাত দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছেন—এই সব আপাত-বস্তুদের প্রত্যেকটার একটা আলাদা নাম দেওয়া আছে। কোনও একটার নাম বই, তো কোনও একটার নাম চেয়ার, এদিকে পালঙ্ক তো ওদিকে গালিচা, এই বাতি, পর্দা, জানলা, দরজা, দেয়াল ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বস্তুর মধ্যে এই বিভাজন তো পুরোটাই কৃত্রিম। কোনও এক প্রাচীন চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করে করা। বাস্তবে এই এতরকম বস্তু বলে তো কিছু নেই। আসলে তো এই গোটা মহাবিশ্বটাই এক এবং অভিন্ন। আমাদেরকে এই রকম আলাদা আলাদা বস্তু বলে ভাবতে শেখানো হয়েছে। এটা, ওটা, সেটা। যখন নাল-‘ও’ বাস্তবায়িত হয়ে যাবে, তখন এই এত বিভাজন যা কিনা শুধুমাত্র মৌখিক, সব উবে যাবে। এই সবের উপযোগিতা অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে।”
“তুমি কি আমাকে একটা কোনও উদাহরণ দিতে পারবে, যে কোনও একটা চাক্ষুষ প্রমাণ?”
লেমুয়েল ইতস্তত করে। “এটা একা একা করা একটু কঠিন। পরে, যখন আমরা বাকিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব . . . অবশ্য ছোট করে চাইলে আমি এখনও এটা দেখাতে পারি, যদিও সেটা আপনার খুব একটা পছন্দের হবে না।”
ড. নর্থ একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে দেখেছিলেন কীভাবে লেমুয়েল অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করে তাঁর চোখের সামনেই এখান ওখান থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র এনে এক জায়গায় গাদা করছে। তারপর, একসময় যখন গাদা-গুচ্ছের বই, ছবি, তোষক, পোষাক, আসবাবপত্র আর এটা-সেটা নানান জিনিস এক জায়গায় জড়ো করা হয়ে গেল, তখন সে সেই সব জিনিসপত্র পরিকল্পিতভাবে একধার থেকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে সবকিছু চটকে মন্ড পাকিয়ে ফেলল।
“দেখতে পাচ্ছেন,” অবশেষে এবার সে মুখ খুলল। একনাগাড়ে এতক্ষণের পরিশ্রমের পর এখন সে কিছুটা ক্লান্ত আর চোখে মুখে একটা ফ্যাকাশে ভাব। “এখানে যত আলাদা আলাদা জিনিস ছিল তাদের কোনোটারই এখন আর কোনও আলাদা অস্তিত্ব নেই। এই যে এত রকম বিভিন্ন বস্তু এখন মিলে মিশে এক হয়ে তাদের মৌলিক অবস্থায় পৌঁছে গেল, এই একই জিনিস এই গোটা মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেও করা যেতে পারে। এই মহাবিশ্ব তো আসলে অখন্ডমন্ডলাকার এক একীভূত পদার্থ, যেখানে সজীব এবং অজীব, অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্বের মধ্যে আসলে কোনও বিভাজনই নেই। শক্তির এক বিশাল ঘূর্ণিবাত্যা, আলাদা আলাদা স্বতন্ত্র কণার কোনও সমাহার নয়! বিভিন্ন বস্তুর বিশুদ্ধ কৃত্রিম চেহারার আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে প্রকৃত বাস্তব জগৎ: ভেদাভেদহীন বিশুদ্ধ শক্তির এক বিস্তৃত জগৎ। মনে রাখবেন: বস্তু বাস্তব নয়। এটাই হচ্ছে নাল-‘ও’ তত্ত্বের প্রথম সূত্র!”
ড. নর্থ গম্ভীর মুখে বসে শুনছিলেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েছেন। এবার উঠে দাঁড়ালেন তিনি। তাঁর সামনে ডাঁই হয়ে পড়ে আছে ভাঙ্গা কাঠের টুকরো, ছেঁড়া কাপড় জামার অংশ, ফর্দাফাই হয়ে যাওয়া কাগজপত্র আর গুড়িয়ে যাওয়া কাঁচের টুকরো-টাকরা। আকারহীন আবর্জনার একটা স্তুপ। তারই একপাশে ধার ঘেঁষে একটা চেয়ারের ভাঙ্গা টুকরো। লাথি মেরে সরিয়ে দিলেন তিনি সেটাকে। “তাহলে তুমি বলছো যে প্রকৃত বাস্তবতার পুনরুদ্ধার করা সম্ভব?”
“আমি সঠিক জানি না,” লেমুয়েল উত্তরটা দিল খুবই সাদামাটাভাবে। “কেননা বিরোধিতা তো অবশ্যই হবে। মানুষেরা তো আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবেই; কেননা বস্তুগত বিষয়ে তারা এখনও বানরদের ধ্যান-ধারণার উপরের স্তরে উঠতে সক্ষম হয়নি—তারা এখনও চকচকে ঝকঝকে জিনিস দেখলেই দখলে নেওয়ার জন্যে হামলে পড়ে। তাই এটা নির্ভর করবে আমরা নিজেরা একে অপরের সঙ্গে কতটা ভালো ভাবে সমন্বয় সাধন করতে পারি তার ওপর।”
পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে সেটা খুলে ফেললেন ড. নর্থ। তারপর সেটার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় ঘোষণা করলেন, “একটা রাস্তা মনে হয় আমার হাতে আছে, একটা লোকের নাম পেয়েছি। আমার মনে হয় উনি তোমাদের কেউ একজন হলেও হতে পারেন। চলো, কাল আগে ওনার সঙ্গে দেখা করি আমরা—তারপর দেখা যাক কী করা যায়।”
***
পালো আল্টো শহরের একদম শেষ প্রান্তে তাঁর সুরক্ষিত ল্যাবরেটরিতে ঢোকার ঠিক মুখেই তাদেরকে সংক্ষিপ্ত কিন্তু প্রাণবন্ত অভ্যর্থনা জানালেন স্বয়ং ড. জ্যাকব ওয়েলার। চারদিকে উর্দিধারী সরকারি রক্ষীরা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার জন্যে অসংখ্য ল্যাবরেটরি সমন্বিত বিশাল এই গবেষণাগারের সুরক্ষা তারাই দেখভাল করে থাকে। গবেষণাগারের ভেতরে গোটা শরীর-ঢাকা সাদা পোশাকের উর্দী পরিহিত পুরুষ আর নারীরা দলে দলে দিবারাত্রি নির্বিশেষে কাজ করে চলেছেন।
“আমি এখানে যে কাজগুলো করছি,” হাতের ইশারায় পেছনের জবরদস্ত প্রবেশ দরজাটার তালা এঁটে দিতে আদেশ দিতে দিতে তিনি তাদেরকে ব্যাখ্যা করছিলেন, “সবই সি-বম্ব তৈরির প্রাথমিক ব্যাপারগুলোর উপর। এটা ঐ কোবাল্ট যুক্ত একরকম এইচ-বম্বই বলতে পারেন। এখানে পরমানুবিদদের তাবড় তাবড় মাথাদের অনেককেই দেখবেন যারা সবাই নাল-‘ও’।”
লেমুয়েলের নিঃশ্বাস প্রায় আটকে গেল। “তার মানে—”
“অবশ্যই।” ওয়েলার একটাও বাড়তি শব্দ উচ্চারণ করলেন না। “আমরা বহু বছর ধরে কাজ করছি। পিনেমুন্দে-তে রকেট নিয়ে শুরু করার পর লস অ্যালামসে প্রথমে এ-বম্ব, তারপর হাইড্রোজেন বম্ব আর এখন এই সি-বম্ব। অবশ্য, এমন নয় যে সবাই, এখানে অনেক বিজ্ঞানী এমনও আছেন যারা নাল-‘ও’ নন, তারা মানসিকভাবে পক্ষপাতদূষ্ট এমনই সাধারন মানুষ। যেমন ধরুন, আইনস্টাইন। কিন্তু আমরা আমাদের সঠিক পথে ঠিকই এগোচ্ছি; খুব বেশি বিরোধিতার সম্মুখীন না হতে হলে খুব তাড়াতাড়িই আমরা অ্যাকশনে নামতে সক্ষম হব।”
কথা শেষ হতেই ল্যাবরেটরির পিছনের দরজাটা একপাশে সরে গেল। খোলা দরজা দিয়ে একদল সাদা পোশাক পরা পুরুষ এবং মহিলা গম্ভীর মুখে ভিতরে এসে ঢুকলেন। সঙ্গে সঙ্গে লেমুয়েলের বুক ধড়াস্ করে উঠল। এই তো এসে গেছেন তারা, পুরোদস্তুর প্রাপ্তবয়স্ক নাল-‘ও’য়েরা! এদের মধ্যে যেমন পুরুষেরাও আছেন তেমনি নারীরাও আছেন, আর বছরের পর বছর ধরে তারা এক সঙ্গে এক লক্ষ্যে কাজ করেও চলেছেন। খুব সহজেই সে তাদের চিনে নিল; সবারই সেই লম্বাটে কান, সবাই কান নাড়াতে পারে, যে কানগুলো দিয়ে মিউট্যান্ট নাল-‘ও’য়েরা সবাই অনেক দূরের থেকেও বাতাসের কম্পন অনুভব করতে পারে। এই সেই ক্ষমতা যার সাহায্যে নিজেদের মধ্যে তারা যখন খুশি যোগাযোগ করতে পারে, তা তারা এই দুনিয়ার যেখানেই থাকুন না কেন।
“আমাদের গোটা প্রোগ্রামটা আপনি একে একটু ভালো করে বুঝিয়ে দিন,” ওয়েলার কথাটা যাকে উদ্দেশ্য করে বললেন তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর পাশেই। ছোটখাট চেহারার একজন মানুষ। মাথা ভর্তি সোনালী চুল। তাঁর মুখের কঠোর ভাব সত্বেও ভদ্রলোককে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি শান্ত সমাহিত ধরনের মানুষ। তবে এই মুহুর্তের গুরুত্ব সম্পর্কেও তিনি রীতিমত ওয়াকিবহাল।
“সি-বম্ব মোটামুটি তৈরি হয়েই গিয়েছে,” ভদ্রলোক ঠান্ডা গলায় ধীর স্থির ভাবে বলতে শুরু করলেন। তাঁর উচ্চারণে সামান্য একটু জার্মান টান রয়েছে। “কিন্তু আমাদের গোটা পরিকল্পনা ধরলে বলতে পারি এটাই শেষ না। চূড়ান্ত লক্ষ্য বহু দূরে। এরপরেই আছে ই-বম্ব, যেটা হবে এই প্রারম্ভিক পর্যায়ের শেষ ধাপ। যদিও এই ই-বম্বের কথা এখনও পর্যন্ত কখনোই আমরা জনসমক্ষে আনিনি। যেহেতু যদি কোনও ভাবে সাধারণ মানুষ এর সম্পর্কে জেনে ফেলে তাহলে তৎক্ষণাৎ আমাদের এই সব ভাবপ্রবণ সাধারণ মানুষের ভয়ংকর মানসিক বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হবে।”
“এই ই-বম্বটা কী জিনিস?” লেমুয়েল জিজ্ঞেস করল। ইতিমধ্যেই উত্তেজনায় তাঁর মুখচোখ চকচকে হয়ে উঠেছে।
“এই ‘ই-বম্ব’ বলতে বোঝায়,” সামান্য বিরতি দিয়ে ছোটখাটো চেহারার সোনালী চুলের মানুষটা আবার বলতে শুরু করলেন, “এমন একটা জিনিসটা যেটা দিয়ে বা এটা এমন একটা প্রক্রিয়া যা ঘটলে এই গোটা পৃথিবীটা নিজেই এমন একটা পিন্ডে পরিনত হবে যার ভর হবে তাঁর ক্রান্তীয় ভরের সমান, আর তখন সে নিজে নিজেই বিস্ফোরিত হয়ে যাবে।”
লেমুয়েল এতক্ষণে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পেরেছে। “আমার ধারণা ছিল না যে আপনার এতদূর পর্যন্ত পরিকল্পনা করেছেন!”
সোনালী চুলের মানুষটা মৃদু হাসলেন। “হ্যাঁ, শুরুর দিনগুলোর কথা ধরলে এটা ঠিকই যে আমরা এর মধ্যেই অনেক কিছু করেছি। ড. রাস্টের নেতৃত্বে আমাদের প্রোগ্রামের ভাবাদর্শগত নীতিগুলোর যাবতীয় প্রাথমিক কাজও আমি এর মধ্যেই শেষ করে ফেলেছি। চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে এই গোটা মহাবিশ্বটাকেই আমরা একটা সমরুপ-ভরের পিন্ডে পরিনত করব। যদিও এই মূহুর্তে আমাদের চিন্তা শুধু পৃথিবী নিয়েই। কিন্তু একবার আমরা এখানে সাফল্য পেয়ে গেলে, তখন অনন্তকালের জন্য কাজ চালিয়ে যেতে না পারার আর কোনও কারণ নেই।”
“এই জন্যে নেই, যেহেতু,” ওয়েলার পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলেন, “এখান থেকে অন্য কোনও গ্রহে চলে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবহণ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়ে গিয়েছে। ডাঃ ফ্রেজার, আপনি বাকিটা—”
“পিনেমুন্দে-তে যে গাইডেড মিসাইল আমরা তৈরি করেছিলাম,” সোনালী চুলের মানুষটা আবার বলতে শুরু করলেন, “সেগুলোর প্রয়োজনীয় অদলবদল করে আমরা একটা মহাকাশযান বানিয়ে নিয়েছি। সেটা আমাদেরকে শুক্র গ্রহে নিয়ে যেতে পারবে।” তারপর সেখানে, মানে ভেনাসে পৌঁছে আমরা শুরু করব আমাদের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ। একটা ভি-বম্ব তৈরি করা হবে। যেটা শুক্রকে তার আদিম অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। শক্তির সেই সমসত্ত্ব অবস্থা, ঠিক যেমনটা শুরুর আগে ছিল। আর তারপর—”
তিনি আবার মৃদু হাসলেন। “আর তারপর একটা এস-বম্ব। সৌর বোমা – দ্য সল্-বম্ব, যদি সবকিছু ঠিকঠাক চলে, যদি আমরা সফল হই, সেটা এই সৌরজগতের যত গ্রহ আর চাঁদ আছে সবগুলোকেই গুড়িয়ে একটা বিশাল গ্যাসীয় পিন্ডে পরিণত করবে।”
***
২৫শে জুন, ১৯৬৯-এর মধ্যেই গোটা বিশ্বের যত বড় বড় দেশ আছে, তাদের প্রত্যেকটারই আসল ক্ষমতা বকলমে নাল-‘ও’য়ের লোকেদের হাতের মুঠোয় চলে গেল। ক্ষমতা দখলের এই ব্যাপারটা, যেটা তলে তলে শুরু হয়েছিল সেই তিরিশের দশকের মাঝামাঝি একটা সময়ে, সেটা এবার এতদিনে কার্যকরী ভাবে সম্পন্ন হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত রাশিয়া দুটো দেশই তখন সম্পূর্ণ ভাবে নাল-‘ও’য়ের লোকেদের হাতের মুঠোয়। যেহেতু যাবতীয় নীতিগত সিদ্ধান্ত সবই তখন নাল-‘ও’য়ের লোকেরাই নিয়ন্ত্রণ করছিলেন, কাজেই নাল-‘ও’য়ের কর্মসূচী রূপায়ণের গতিও তখন আরও জোরদার হয়ে উঠেছে। এমনিতেও এবার সময় হয়ে গিয়েছে। তাই লুকোছাপারও আর কোনও দরকার নেই।
একটা রকেটে করে চরকি পাক খেতে খেতে লেমুয়েল আর ড. নর্থ প্রথম এইচ-বম্বটাকে বিস্ফারিত হতে দেখলেন। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তৈরি নিখুঁত পরিকল্পনা। দুটো রাষ্ট্রই এইচ-বম্বের হামলা শুরু করল একই সঙ্গে একই সময়ে। প্রথম এক ঘন্টার মধ্যেই আশাতিরিক্ত ফলাফল পাওয়া গেল। উত্তর আমেরিকা আর পশ্চিম ইউরোপের বেশিরভাগ জায়গাই উবে গেছে। এখন শুধু সেখানে রয়েছে তরঙ্গায়িত ভাসমান তেজস্ক্রিয় কণার বিশাল বিশাল মেঘের দল। যতদূর চোখ যায় চারদিকে গর্ত আর গর্ত। বিজকুরি কাটছে গলিত ধাতুর বুদবুদ। আর ওদিকে আফ্রিকায়, এশিয়ায়, অসংখ্য দ্বীপে আর দূরদূরান্তের বিজন জায়গায় তখনও বেঁচে থাকা মানুষেরা আতঙ্কে কাঁপছে।
“একদম নিখুঁত কাজ,” লেমুয়েলের কানে ভেসে এলো ড. ওয়েলারের কণ্ঠস্বর। তিনি ভূপৃষ্ঠের নীচেই কোথাও আছেন। মাটির অনেক গভীরে সযত্নে সুরক্ষিত সদর দফতরে। শুক্রে যাওয়ার মহাকাশযানটার শেষ পর্যায়ের কাজ তখন সেখানেই চলছিল।
লেমুয়েলও অবশ্য একমত হল। “দারুণ কাজ হয়েছে। আমরা পৃথিবীর স্থলভাগের অন্তত এক পঞ্চমাংশকে গুড়িয়ে এক-করে দিতে পেরেছি!”
“তবে এখনও অনেক কিছু হওয়া বাকি আছে। এরপর ছাড়া হবে সি-বম্ব। তখন আর মানুষেরা আমাদের চূড়ান্ত কাজে কোনও বাধা দেওয়ার মতো জায়গাতেই থাকবে না। ই-বম্বগুলো যেখানে যেখানে বসানো হচ্ছে সেখানে কেউ আর কোনও ঝামেলা করতে পারবে না। টার্মিনালগুলো বসানোর কাজ এখনও চলছে। সাধারণ মানুষেরা সেখানে ঝামেলা করলে সেই কাজ ঠিকঠাক ভাবে করা সম্ভব হবে না।”
পরের এক সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগেই ঘটানো হল প্রথম সি-বিম্বটার বিস্ফোরণ। তারপর আরও এল, আঘাতের পর আঘাত আসতে থাকল রাশিয়া আর আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় সযত্নে লুকিয়ে রাখা লঞ্চারগুলো থেকে।
১৯৬৯ এর ৫ই আগস্টের মধ্যে গোটা বিশ্বের জনসংখ্যা নেমে গেল তিন হাজারের নিচে। আর নাল-‘ও’য়েরা, তাদের ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারের অফিসে বসে খুশিতে উচ্ছল, তাদের মুখচোখ তৃপ্তিতে জ্বলজ্বল করছে। পরিকল্পনা মতোই চলছিল সব কিছু গুড়িয়ে এক করে দেওয়ার কাজ। স্বপ্ন এবার সত্যি হয়েই এল প্রায়।
***
“এখন,” ড. ওয়েলার ঘোষণা করলেন, “আমরা ই-বম্ব টার্মিনাল তৈরির কাজ শুরু করতে পারি।”
একটা টার্মিনাল শুরু হল পেরুর আরিকিপাতে। আরেকটা যেটা, সেটা হল পৃথিবীর একদম উল্টো দিকে, জাভার বান্দুংয়ে। মাসখানেকের মধ্যেই ধুলোয় ঢাকা আকাশের বুকে বিশাল বিশাল দুটো মিনার খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। নাল-‘ও’য়েদের দুটো কলোনিই ভারী ভারী নিরাপত্তা পোষাক আর হেলমেট পরে দিনরাত এক করে কাজ করেছিল।
ড. ওয়েলার লেমুয়েলকে নিয়ে উড়ে গেলেন পেরুর টার্মিনালে। সান ফ্রান্সিসকো থেকে লিমা পর্যন্ত গোটা পথেই শুধুই ঘূর্ণায়মান ছাই আর এখানে সেখানে কয়েকটা জায়গায় তখনও পর্যন্ত জ্বলন্ত ধাতব আগুন ছাড়া আর কোথাও কিছুই চোখে পড়ল না। কোথাও কোনও প্রাণের চিহ্ন তো দূরের কথা, আলাদা করে কোনও কিছুরই কোথাও কোনও অস্তিত্ব নেই, সবকিছুই মিশে গেছে বর্জ্যপদার্থের এক বিশাল স্ফীতির মধ্যে। মহাসাগরগুলো নিজেরাও সব এক একটা বাষ্প আর ফুটন্ত জলের আকর। মুছে গিয়েছে স্থল আর জলের মধ্যেকার সমস্ত পার্থক্য। যেখানে এক সময় ছিল নীলাভ মহাসাগর আর সবুজ বনভূমি, ছিল রাস্তাঘাট আর শহর, মাঠ আর ক্ষেত, এই পৃথিবীর সেখানে এখন শুধুই বিষণ্ণ ধূসর আর সাদার এক অনন্য বিস্তৃতি।
“ঐ যে, ওখানে,” ড্. ওয়েলার ইশারা করে বললেন, “দেখতে পাচ্ছো?”
দেখতে লেমুয়েল ঠিকই পেয়েছিল। তবে ততক্ষণে সেটার নিখুঁত সৌন্দর্যে অভিভূত তাঁর নিঃশ্বাস তাঁর গলার কাছে আটকে গেছে। তরল ধাতব-বর্জ্যের ঘূর্ণায়মান সমুদ্রের মধ্যে নাল-‘ও’য়েদের তৈরি করা বুদবুদের মতো দেখতে বিশাল বিস্তৃত একটা ভাসমান সুরক্ষা বর্ম। প্লাস্টিকের একটা ভাসমান স্বচ্ছ গোলক। সেই বুদবুদের মধ্যে ধাতু আর তারের জটিল মাকড়সার জালের মতো ঝকঝকে আলো ঠিকরানো স্বয়ং-দৃশ্যমান টার্মিনালটা ড. ওয়েলার আর লেমুয়েল দুজনকেই নির্বাক করে দিল।
“তবে কথা হচ্ছে এই যে,” সুরক্ষা-বর্মের বায়ুরোধী প্রবেশদ্বারের মধ্যে দিয়ে রকেট নামাতে নামাতে ড. ওয়েলার কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে বলছিলেন, “আপাতত আমরা ভূপৃষ্ঠের খানিকটা আর তার নিচের বড়জোর মাইল খানেক পাথুরে অংশই গুড়িয়ে দিতে পেরেছি। এই বিশাল গ্রহের ভরের কিন্তু এখনও কোনও পরিবর্তন হয়নি। তবে হ্যাঁ, ই-বম্ব সেটা সামলে নেবে। গ্রহের অন্তস্থল যা এখনও পর্যন্ত তরল সেই মজ্জা অংশটুকুও তখন বিস্ফোরিত হবে; পুরো গোলকটাই একটা নতুন সূর্যে পরিণত হবে। আর তারপর যখন এস-বম্ব বিস্ফোরিত হবে, তখন সম্পূর্ণ সৌরজগতটাই একটা জ্বলন্ত গ্যাসের সমসত্ব পিন্ডে পরিণত হয়ে যাবে।”
লেমুয়েল মাথা নাড়ল। “যৌক্তিক। আর তারপর—”
“তারপর জি-বম্ব। পরের ধাপেই যাবে গোটা গ্যালাক্সি—আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথ। গোটা পরিকল্পনার এই যে চূড়ান্ত পর্যায়—সেটা এতটাই বিশাল, এতটাই ভয়ঙ্কর ব্যাপার যে আমরা খুব কমই সেই সব নিয়ে আলোচনা করার মতো সাহস করে উঠতে পারি। এই জি-বম্ব, আর তারপর সব শেষে—”ওয়েলার একটু হাসলেন, তাঁর চোখ দুটো ঝকঝকে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “তারপর ইউ-বম্ব।”
নেমে এলেন তারা। নেমেই দেখা পেলেন ড. ফ্রেজারের। তিনি স্নায়ুচাপে তখন বিচলিত। উত্তেজনায় প্রায় কাঁপছেন। “ডঃ ওয়েলার!” তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে শুরু করলেন। “কিছু একটা ভুল হয়েছে!”
“সে কী?”
ফ্রেজারের চোখমুখ হতাশায় সম্পূর্ণ বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। তবে নাল-‘ও’ সুলভ প্রবল এক প্রচেষ্টায় তিনি তাঁর যাবতীয় মৌলিক মানসিক শক্তি সংহত করে শেষ পর্যন্ত এই হঠাৎ উদ্ভূত মানুষী আবেগ ছুঁড়ে ফেলতেও সক্ষম হলেন। “একটা বিশাল সংখ্যক মানুষ কিন্তু বেঁচে গেছে!”
ওয়েলার বিশ্বাসই করতে পারছেন না। “কী বলতে চাইছেন? কীভাবে—”
“আমি তাদের গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে গেছি। আমি কান ঘুরিয়ে এদিক ওদিক কোথায় কিসের শব্দ হচ্ছে শোনার চেষ্টা করতে করতে বুদবুদের বাইরে বর্জ্য-সমুদ্রের গর্জন আর ঢেউয়ের উথালপাথাল শব্দ উপভোগ করছি, ঠিক তখনই হঠাৎ আমি শুনতে পেলাম সাধারণ মানুষের কন্ঠস্বর।”
“কিন্তু কোথায় সেটা কিছু বুঝলেন?”
“ভূপৃষ্ঠের নিচে। মনে হচ্ছে সরকারি আদেশ লঙ্ঘন করেও ধনকুবের শিল্পপতিদের কেউ কেউ গোপনে সেখানে তাদের কারখানাগুলো সরিয়ে নিয়েছিল, আর এখন সেখান থেকেই আসছে এই সব আওয়াজ।”
“হ্যাঁ, সেটা হতে পারে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের একটা সুস্পষ্ট নীতিও তো ছিল।”
“ছিল। কিন্তু এই সব শিল্পপতিরা টিপিক্যাল থ্যালামিক লোভের বশবর্তী হয়েই এই সমস্যা তৈরি করেছে। এদের ভয়ের তুলনায় লোভ খুব বেশি। যুদ্ধ শুরু হতেই এরা গোপনে এদের শ্রমিকদের সবাইকে ভূগর্ভস্থ কারখানায় দাস হিসাবে কাজ করার জন্যে সরিয়ে নেয়। ফলে অন্তত হাজার দশেক মানুষ হাত ফস্কে গেছে। এরা সবাই এখনও বেঁচে আছে। আর—”
“আর . . . ?”
“কোনও ভাবে এরা বিশাল বিশাল সব সুড়ঙ্গ বানিয়ে নিয়েছে আর এখন দলে দলে সেই সুড়ঙ্গ ধরে এদিকেই উঠে আসছে। আমাদের এবার মুখোমুখি লড়াইয়ে নামতেই হবে। আমি ইতিমধ্যে শুক্রযানে খবর পাঠিয়ে দিয়েছি। এর মধ্যেই ওটাকে ভূপৃষ্ঠে উঠিয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা শুরু করা হয়ে গেছে।”
লেমুয়েল আর ড. ওয়েলার দুজনেই দুজনের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। নাল-‘ও’য়েরা সংখ্যায় বড়জোর হাজার খানেক হবেন; বিপক্ষের দশজনের তুলনায় মাত্র একজন। সংখ্যার দিক থেকে তারা আগেই হেরেই গেছেন। “এ তো অত্যন্ত ভয়ানক ব্যপার হয়ে গেল,” প্রায় বুজে আসা গলায় ওয়েলার কোনও রকমে বলে উঠলেন। “ঠিক যখন মনে হচ্ছিল সবকিছু এবার সুখদ পরিসমাপ্তির দিকে পৌঁছে গেছে, তখনই এমন হয়ে গেল। শক্তিকেন্দ্রগুলো তৈরি শেষ হতে আর কতক্ষণ লাগবে?”
“পৃথিবীকে তাঁর ক্রান্তীয় ভরের জায়গায় নিয়ে আসার জন্যে মোটামুটি আরও দিন ছয়েক তো লাগবেই,” মনে মনে কিছু একটা হিসেব করে নিয়ে ফ্রেজার বিড়বিড় করে উত্তর দিলেন। “এদিকে সুড়ঙ্গগুলো খুঁড়ে ওরা প্রায় এখান পর্যন্ত চলেই এসেছে। আপনাদের কানগুলো একটু এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখুন। এই এখান থেকেই ওদের আওয়াজ শুনতে পাবেন আপনারা।”
লেমুয়েল আর ডাঃ ওয়েলার সেটাই করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাদের কানে এল মানুষের গলার আওয়াজ। হৈচৈ, চীৎকার-চেঁচামেচির বিশৃঙ্খল শব্দের জগাখিচুড়ি একটা কলরব। মনে হচ্ছে বেশ কয়েকটা সুড়ঙ্গ ধরে সেই জগাখিচুড়ি শব্দের কলরব টার্মিনাল দুটোর বুদবুদের দিকেই সরাসরি এগিয়ে আসছে।
“যত পাতি-সাধারণ মানুষের দল সব!” লেমুয়েল হাঁপাচ্ছে। “আওয়াজ শুনেই আমি ধরতে পেরে গেছি!”
“আমরা ফাঁদে পড়ে গেছি!” কথাটা বলেই ওয়েলার একটা ব্লাস্টার বের করে বাগিয়ে ধরলেন, দেখাদেখি ফ্রেজারও তাই করলেন। উপস্থিত প্রত্যেক নাল-‘ও’য়েরাও সবাই নিজেদের অস্ত্র বের করে তৈরি হয়ে নিলেন। আপাতত কাজকর্ম সব শিকেয় রাখা থাকুক। ঠিক এই সময় শোনা গেল প্রচণ্ড ভয়ংকর একটা গর্জন। যেন সব ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে। মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল একটা সুড়ঙ্গ মুখ। মুখটা সোজা ওদের দিকেই খুলেছে। নাল-‘ও’য়েরা সেদিকে তাক করে তুমুল এলোপাথারি গুলি চালাতে শুরু করলেন; সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে আসা মানুষের দলটার সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে ফিরে গেল টাওয়ারের দিকে।
দ্বিতীয় আরেকটা সুড়ঙ্গমুখ খুলে গেল, আর তার পরে পরেই তৃতীয়টা। নাল-‘ও’য়েদের গুলির উত্তরে মানুষেরাও গুলি চালিয়ে জবাব দিতে শুরু করতেই এনার্জি বীমের শক্তির আগুনে চারপাশের বাতাস পর্যন্ত আগুন হয়ে উঠল। মানুষদের দলে যারা রয়েছে তারা একেবারেই অতি সাধারণ মানুষ। এমনিতে তারা বিভিন্ন ধরণের শ্রমিক। মাটির নিচে তাদের নিয়ে এসেছিল তাদের নিয়োগকর্তারা। ফলে বলতে গেলে ভাগ্যের জোরেই তারা প্রাণে বেঁচে গিয়েছে। মানুষ হিসেবে তারা একেবারেই নিম্ন শ্রেণীর মানুষ। তাদের মধ্যে কেউ কেরানি, তো কেউ বাস ড্রাইভার, কেউ দিনমজুর, তো কেউ টাইপিস্ট, সেখানে যেমন আছে দারোয়ান, দর্জি, রুটি কারখানার কর্মী, টারেট-লেদ চালক, শিপিং-ক্লার্ক, বেসবল খেলোয়াড়, রেডিও-ঘোষক, গ্যারেজ মিস্ত্রি, পুলিশ কনস্টেবল, ছ্যাচড়া চোর, আইসক্রিম-ওয়ালা, তেমনি আছে দরজায় দরজায় ঘোরা ফেরিওয়ালা, বিল কলেক্টর, রিসেপসনিস্ট, ওয়েল্ডার, ছুতার, নির্মাণ শ্রমিক, কৃষক, রাজনীতিবিদ, দোকানদার—এরা সবাই অতি সাধারণ পুরুষ আর মহিলা—যাদের শুধু অস্তিত্বই এখন আমূল আতঙ্কিত করে দিল নাল-‘ও’য়েদের গোটা দলটাকে।
বুক ভর্তি প্যাচপ্যাচে আবেগ নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া এই সব সাধারণ মানুষেরা, যারা এই মহান পবিত্র-কর্মের প্রতি ক্ষুব্ধ, যারা রীতিমত ঘেন্না করে এইসব বোমা আর ব্যাকটেরিয়া আর গাইডেড মিসাইল, তারা এবার উঠে এসেছে ভূপৃষ্ঠের উপরে। তারা উঠে দাঁড়িয়েছে—ঘুরে দাঁড়িয়েছে শেষ পর্যন্ত। তারা চাইছে অতি-মানবীয় যুক্তিবাদের সমাপ্তি ঘটাতে: যে যুক্তিবাদে যৌক্তিকতা থাকলেও দায়বদ্ধতা নেই।
“মনে হয় না আমাদের আর কোনও উপায় আছে,” ওয়েলার কোনোরকমে বলে উঠলেন। তাঁর দম আটকে আসছে। “টাওয়ারের কথা এখন ভুলে যান। আগে জাহাজটা উপরে নিয়ে আসুন জলদি।”
ততক্ষণে ওদিকে একজন ফেরিওয়ালা আর দুজন কল-মিস্ত্রি মিলে টার্মিনালে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। ক্যানভাসের শার্টের উপর ওভারঅল পরা একদল লোক চারপাশ থেকে সেটার তার-টার ছিঁড়ে উপড়ে ফেলছিল। তাদের মতোই অতি সাধারণ মানুষদের আরেকটা দল ততক্ষণে হাতের হিট-গানগুলো ঘুরিয়ে দিয়েছে বিদঘুটে জটিল কন্ট্রোলগুলোর উপরে। জ্বলে উঠছে আগুনের লেলিহান শিখা। ভয়ানক ভাবে দুলছে টার্মিনাল টাওয়ারটা।
এরই মধ্যে শুক্রযানও এসে হাজির। জটিল কয়েক ধাপের একটা পদ্ধতিতে সেটাকে উঠিয়ে আনা হয়েছে ভূপৃষ্ঠের উপর। তৎক্ষণাৎ নাল-‘ও’য়েরা দুটো সারিতে ভাগ হয়ে গেল। ঢুকে পড়তে শুরু করল যানটার মধ্যে। এদিকে পাগল হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের দলটাও। ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাদের উপর। কচুকাটা করে কেটে ফেলছে যাকে পাচ্ছে হাতের কাছে। তার মধ্যেও কিন্তু চমৎকৃত করে দেওয়ার মতো আত্মনিয়ন্ত্রন আর সংহতির শৃঙ্খলা দেখাল তারা—নাল-‘ও’য়েরা।
“জানোয়ারের দল,” গভীর দুঃখের সঙ্গে বলে উঠলেন ওয়েলার। “মানুষের পাল। শুধু আবেগের বশে চলা নির্বোধ একটা প্রাণী। জানোয়ার ছাড়া আর কিচ্ছু নয়, যুক্তিতর্ক বোঝার কোনও ক্ষমতাই নেই।”
আর কিছু বলার আগেই এক ঝাঁক তাপ-রশ্মি তাকে চিরকালের মতো চুপ করিয়ে দিল। ঠিক তাঁর পেছনের জন তাঁর শরীরটার পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত যখন বেঁচে থাকা অবশিষ্ট নাল-‘ও’য়েদের শেষ জনও জাহাজে উঠে পড়ল, তখন বিশাল আকৃতির হ্যাচগুলো সব ধপাধপ বন্ধ হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ প্রচণ্ড একটা গর্জন করে চালু হয়ে গেল সবকটা জেট। আর ঠিক তার পরের মূহুর্তেই বুদবুদ ভেদ করে আকাশে উড়ে গেল মহাকাশযানটা।
লেমুয়েল তখনও পর্যন্ত সেখানেই পড়ে ছিল যেখানে এক পাগলা ইলেকট্রিশিয়ানের হিট-বিম তাঁর বাঁ পা-টাকে স্পর্শ করাতে সে পড়ে গিয়েছিল। বিমর্ষ চোখে সে তাকিয়ে ছিল মহাকাশযানের উড়ে যাওয়ার দিকে। আকাশের বুকে সেটা যেন একটু সময়ের জন্য ইতস্তত করল। তারপর একটা গোত্তা মেরে জ্বলন্ত আকাশের বুক ফেঁড়ে উড়ে গেল দূরের দিগন্তের দিকে। তাঁর চারপাশে এখন শুধুই মানুষের ভীড়। সব পাতি সাধারণ মানুষ। যাদের একদল এই মূহুর্তে অত্যন্ত ব্যস্ত ক্ষতিগ্রস্থ সুরক্ষা-বুদবুদের মেরামতিতে, কেউ চিৎকার করে আদেশ দিচ্ছে। কেউ কেউ উত্তেজনায় এমনিই চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে। তাদের যাবতীয় চিৎকার চেঁচামেচি, তাদের কলরব, সব কিছুই তাঁর সংবেদনশীল কানের পর্দায় এসে দমাদম আঘাত করছে; অনেক চেষ্টা চরিত্র করে সে হাত তুলে কোনও রকমে কানদুটো হাতের তেলোয় ঢাকা দিয়ে রাখল লেম।
মহাকাশযানটাও চলে গেছে। পেছনে ফেলে রেখে চলে গেছে তাকে। তবে তাকে ছাড়াই এই পরিকল্পনা এগিয়ে যাবে।
বহু দূর কোথাও থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল তার কানে। ড. ফ্রেজারের কন্ঠস্বর। শুক্রযানে বসে ডঃ ফ্রেজার মুখের সামনে দু হাতের তালু জড়ো করে নিচের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছিলেন। চীৎকারটা ক্ষীণ হয়ে এসে পৌঁছচ্ছে লেমুয়েলের কাছে। বেশিটাই হারিয়ে গেছে মাইলের পর মাইল মহাশূন্যে। তবে তাঁর চারপাশের চীৎকার চেঁচামেচি আর কলরবের মধ্যে থেকেও লেমুয়েল সেই ক্ষীণ আওয়াজের অর্থ উদ্ধার করতে পেরে গেল।
“বিদায়... আমরা তোমাকে মনে রাখব—”
“আপনারা কাজটা চালিয়ে যাবেন!” ছেলেটা পাল্টা চিৎকার করে উঠল। “পরিকল্পনা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত হাল ছাড়বেন না!”
“আমরা কাজটা করব...” কন্ঠ এবার আরো ক্ষীণ হয়ে এল। “আমরা চালিয়ে যাব...” তারপর আর কিছু শোনা গেল না। শেষের শব্দগুলো সব হারিয়ে গেল মহাশুন্যে। তারপর হঠাৎ এক মূহুর্তের জন্য আবার ফিরে এল কন্ঠস্বরটা। “আমরা সফল হবই...” আর তারপর আবার অনন্ত নীরবতা।
লেমুয়েল শুয়ে রইল সেখানেই। তাঁর মুখে প্রশান্ত একটা হাসি। সেই হাসি শুধুই সুখ আর তৃপ্তির। একটা কাজ ভালভাবে সম্পন্ন হওয়ায় সে এখন সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট। লেমুয়েল এবার শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কখন অযৌক্তিক মানব পশুদের দলটা তাকে শেষ করার জন্য এগিয়ে আসে।
---------------------------------------------------------------------------------
টীকা:
(*১)- Minnesota Multiphasic – মিনেসোটা মাল্টিফ্যাসিক হচ্ছে পার্সোনালিটি পরীক্ষার উদ্দেশ্যে মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে স্টার্ক আর. হ্যাথাওয়ে এবং জেসি ম্যাককিনলের তৈরি করা এক পরীক্ষা। যা ১৯৪৩ সালে ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটা প্রেস কতৃক প্রথম বার প্রকাশিত হয়।
(*২) – Rorschach blots – রোরশ্যাচ পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত ব্লটিং পেপার। ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য এবং মানসিক কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য এই মনঃসমীক্ষকরা এই পরীক্ষাটি ব্যবহার করেন। বিশেষ করে এটি ব্যক্তির অন্তর্নিহিত চিন্তার ব্যাধি সনাক্ত করার কাজে তখন লাগে যখন রোগী তাঁর চিন্তাভাবনার প্রক্রিয়া প্রকাশ্যে বর্ণনা করতে অনিচ্ছুক।
(*৩) বেন্ডার-গেস্টাল্ট পরীক্ষাটি মূলত ১৯৩৮ সালে শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ লরেটা বেন্ডার দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল । একটি মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা যা ৩ বছর বা তার বেশি বয়সী এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ভিজ্যুয়াল-মোটর কার্যকারিতা, বিকাশজনিত ব্যাধি এবং স্নায়বিক বৈকল্যের মূল্যায়ন করে।
(*৪) – Rhine deck of ESP – ড. জোসেফ রাইন এক্সট্রাসেন্সরি পারসেপশন বা অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে রোগীর মানসিক ক্ষমতা পরিমাপ করার জন্য যে পাঁচটি ভিন্ন আকৃতির কার্ড ব্যবহার করতেন সেগুলোকেই রাইন ডেক বলা হয়—এতে থাকে ২৫টা কার্ডের একটা গোছা। সেখানে পাঁচ রকম প্রতীকের পাঁচটা করে কার্ড থাকে। এই পাঁচটা প্রতীক হল একটা বৃত্ত, একটা যোগ চিহ্ন, তিনটা খাড়া তরঙ্গায়িত রেখা, একটা বর্গক্ষেত্র আর একটা পঞ্চমুখি তারা। ১৯৩০ এর দশকের শুরুতে কার্ডগুলোর রুপরেখা তৈরি করেছিলেন প্যারাসাইকোলজিস্ট জে.বি. রাইন (১৮৯৫-১৯৮০)তাঁর সহকর্মী মনোবিজ্ঞানী কার্ল জেনার (১৯০৩-১৯৬৪)-এর সঙ্গে যৌথ ভাবে। এই কার্ডগুলোকে জেনার কার্ড বলেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এই ইএসপি কার্ড নামে পরিচিত কার্ডগুলো দিয়ে মানসিক ক্ষমতার পরিমাপ, বা টেলিপ্যাথি আর ক্লেয়ারভায়েন্স পরীক্ষা করা হত।
(*৫) – Ouija Board – প্ল্যানচেটে ব্যবহৃত কাঠের বোর্ড। একে জাদুকরী বোর্ডও বলা হয়। এই বোর্ডের উপর ০ থেকে ৯ আর বর্ণমালার অক্ষর সাজানো থাকে। প্ল্যানচেটের সময় মিডিয়াম তাঁর হিস্টিরিক ঘোরে এগুলো নাড়াচাড়া করে আগত মৃত আত্মার তরফে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকে।
(*৬) – A piece of lead to be turned into gold – অ্যালকেমি বা অপরসায়নের সেই মধ্যযুগীয় রহস্যময় উপাদান যা বহু যুগ ধরে ইউরোপের (অপ)রসায়নবিদদের কাঁধে বেতালের মতো চড়ে বসে ছিল। অসংখ্য অপরসায়নবিদ জীবনপাত করে গেছেন সীসা থেকে সোনা তৈরি উদ্দেশ্যে।